Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বুলেটে হারায় ফুটবল, কেঁপে ওঠে শহরতলি

সবুজ বাক্সের ভিড় খুব চোখে পড়ে জায়াগাটায়। লোহার গেটের ফাঁকে, গুল্মছায়ায়। এক-একটায় মরচে পড়েছে একটু, ফ্রান্সে আসলে সময়-অসময়ে বড় বৃষ্টি পড়ে। তবে বেশির ভাগই ঝকঝকে। নিপাট নতুন। পাড়ায়-পাড়ায় বাড়ির পাঁচিল জড়িয়ে সবুজ বাক্সগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, অবোধ শিশুর মা-কে আঁকড়ে থাকার মতো।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় l প্যারিস শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৬ ০৪:০০
Share: Save:

সবুজ বাক্সের ভিড় খুব চোখে পড়ে জায়াগাটায়। লোহার গেটের ফাঁকে, গুল্মছায়ায়। এক-একটায় মরচে পড়েছে একটু, ফ্রান্সে আসলে সময়-অসময়ে বড় বৃষ্টি পড়ে। তবে বেশির ভাগই ঝকঝকে। নিপাট নতুন। পাড়ায়-পাড়ায় বাড়ির পাঁচিল জড়িয়ে সবুজ বাক্সগুলো দাঁড়িয়ে থাকে, অবোধ শিশুর মা-কে আঁকড়ে থাকার মতো।

ডাকবাক্স সব।

শোনা গেল, এটাই নাকি এলাকার অলিখিত নিয়ম। বাড়ি পিছু একটা রাখতে হবে। নইলে বড় অসুবিধে। কেন? ই-মেলের যুগে আপনারা হাতে এত চিঠি লেখেন?

প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসতে থাকেন হোটেল মালিক। “কাজের বাইরে আমরা খুব একটা ই-মেল ব্যবহার করি না কিন্তু। আমাদের সব বাড়িতে খাম থাকে। স্ট্যাম্প কিনে রাখি। অনেক দরকারে লাগে।” যেমন? উত্তর আসে— যেমন, কোম্পানি ব্রোশিওর, কোনও হোটেলের সচিত্র লিফলেট পৌঁছনো। বাড়ির ডাকবাক্সে ফেলে দিলেই চলে। লোককে ডেকে বিরক্ত করতে হয় না। সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন, তাতেও লাগে। গোটাটাই ডাকযোগ। ফর্ম ভরে কোম্পানিতে পাঠাতে হবে। তার পর অ্যাক্টিভেশনের প্রশ্ন।

এই হল মালাকফ। হোটেল মালিক ভদ্রলোকের বহু বছর হয়ে গেল এই ফরাসি শহরতলিতে। এখানকার প্লেতো দ্য ভঁ মেট্রো স্টেশন থেকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই তাঁর বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের ব্যবসা— ‘পাতিও বারিকঁ’। প্রায় দশ বছর ধরে চলছে। প্যারিস বলতে বাঙালি যা বোঝে, মালাকফ কিন্তু তার চেয়ে বেশ দূরে। এ যেন আমাদের ইছাপুর বা দত্তপুকুর। এখান থেকে শঁজেলিজে বা আইফেল টাওয়ারে যেতে হলেও হাতে অন্তত চল্লিশ মিনিট রাখতে হয়। তার মধ্যে মেট্রো লাইন পাল্টাতে হবে দু’বার। আবার স্যাঁ দেনি-তে ইউরো কাপের ম্যাচ দেখতে যাওয়ার কথা কেউ ভাবলে পকেটে বেশি টাকা থাকা আবশ্যক। কারণ, খেলা টাইব্রেকারে গড়ালে নিশ্চিত ভাবেই আপনি বাড়ি ফেরার মেট্রো পাবেন না। প্লেতো দ্য ভঁ ছোট স্টেশন, বেশি রাত পর্যন্ত খোলা থাকে না। নিজের স্টেশন পেরিয়ে এসে তখন আপনাকে নামতে হবে বড় জংশনে। সেখান থেকে ফিরতে হবে ট্যাক্সি নিয়ে। যেন এসপ্ল্যানেড থেকে মেট্রোয় দমদমে নেমে আবার ট্যাক্সিতে শ্যামবাজার ফেরা। মধ্যরাতের যন্ত্রণা!

“জানি, এটা অভিজাত এলাকা নয়। কিন্তু এখানে শান্তি আছে। প্রচুর লোক তাই থাকে এখানে,” বলে ফেলেন নোয়া নামের হোটেল মালিক। ভুল বলেনও না। প্লেতো দ্য ভঁ মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে যদি যান, রু এদগার কুইন পড়বে। ছবির মতো পরপর বাড়ি, কাচের জানলা, ছাদে চিমনি। অদ্ভুত পরিচ্ছন্ন চার দিক। রাস্তাঘাট নোংরা করা এমনিতেই ফরাসিদের স্বভাবে নেই। মোড়ে মোড়ে ডাস্টবিন আছে। প্লাস্টিক প্যাকেট থেকে তরিতরকারির খোসা, সব জমা করতে হয় ওখানে। মালাকফ একই ধর্ম মানে। ফিটফাট থাকে।

রু এদগার কুইন থেকে দু’টো রাস্তা দু’দিকে চলে যায়। একটা রু গাব্রিয়েল ক্রি। আর একটা রু দানি কোর্ট। রু গাব্রিয়েল ক্রি ধরে হাঁটতে-হাঁটতে একটা বিশাল ফাঁকা চত্বর পড়ে। স্থানীয়রা বলেন, ‘থিয়েটার সেভেন্টি-ওয়ান’। মালাকফে থিয়েটারের রমরমা বাজার। শো হয় প্রতিদিন। টিকিট কাটা নিয়েও বিশেষ ভাবতে হয় না। কাউন্টার তো আছেই। হোটেলে চাইলেও দিয়ে দেবে।

থিয়েটার সেভেন্টি-ওয়ান এরিয়ার দু’টো রূপ। সকালে এক রকম সৌন্দর্য, সন্ধেয় আর এক। সন্ধেয় ফুটবল নিয়ে কিশোরদের ছুটোছুটি। সন্তানকে প্র্যামে বসিয়ে পায়চারি করেন মা। আবার সকালে সেখানেই দেখা যাবে, এক চিলতে ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই। সার-সার দোকান, জমজমাট বাজার। নানা দেশের মানুষ। ফরাসি, বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি। কারও জামা-কাপড়ের দোকান, কেউ বা ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা চালাচ্ছেন বছর পাঁচেক হল। জামা-কাপড়ের দামও সস্তা। পাঁচ ইউরো দিলে একটা ভাল সোয়েট শার্ট হয়ে যাবে। মাছ-মাংস-আনাজপাতি কিনতে হলে পাশের কমপ্লেক্সে যাও। ছোট ছোট বোর্ডে প্রত্যেক জিনিসের দাম ঝোলানো। দরাদরির প্রশ্ন নেই, ফিক্সড প্রাইস। এক কেজি হ্যাম কিনতে খরচ বারো ইউরো। স্যামন বা টার্বট মাছ আরও কম। দশ ইউরো দিলে অন্তত তিন দিন নিশ্চিন্ত।

বুধবার সকালে বাজারে ঘুরতে-ঘুরতে পদ্মাপারের এক যুবকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি, ইশতিয়াক পারভেজ জয়দীপ। ইউরোর সময়ে ব্যবসাটা একটু বাড়িয়েছেন। জামা-কাপড়ের দোকান আছে, যেমন ছিল। তার সঙ্গে দেশ-বিদেশের ফ্ল্যাগ, গ্রিজম্যান-রোনাল্ডোর জার্সি। বিক্রি ভাল চলছে নিশ্চয়ই? বৃহস্পতিবার তো ফ্রান্স-জার্মানি। বাঙালি যুবক তাঁর প্রার্থনার কথা শোনান। ফ্রান্স জিতলে তাঁর বড় সুবিধে। একটু বেশি ইউরো হাতে আসবে এ মাসে। “ফ্রান্সকেই সমর্থন করছি তাই। আসলে সমর্থন করি আর্জেন্তিনাকে,” বলে ফিক করে হেসে ফেলেন বঙ্গসন্তান। একদম গায়েই দোকান যাঁর, তিনি তখন হাঁকডাক করছেন ছেলের ওপর। দিল্লিবাসী ললিত শর্মার টেলিফোন পার্টসের ব্যবসা ভাল চলছে না। অতএব ললিত শর্মা তখন অগ্নিশর্মা। “ছেলেটাকে বললাম, বাড়ি থাকতে। পড়াশোনা করতে। ঠিক সঙ্গে চলে এল।” ফ্রান্স না জার্মানি? কাকে সমর্থন করছেন কাল? “ধুর, ফ্রান্স-জার্মানি! আমি ভাবছি কবে হ্যান্ডিক্রাফটের ব্যবসাটা আবার শুরু করতে পারব। ওটা অনেক ভাল ছিল। সস্তার ইলেকট্রনিক্সের জিনিস এখানে কেউ কিনতে চায় না!”

রাগী ভারতীয়, লাজুক বাঙালিকে ফেলে বাঁ দিকের গলিতে ঢুলে পড়লে চারপাশ পাল্টে যায়, পরিবেশ বদলে যায় দ্রুত। গিজগিজে কফিশপ, খাবারের দোকান। জাপানি, চিনে, ইতালীয়, ফরাসি, ভারতীয়— কত রকম। পিৎজার দোকান বিকেলের আগে খোলে না। জাপানি ‘ওয়াহা’ রেস্তোঁরা কিন্তু সকাল ন’টাতেও সুশি-নুডলস নিয়ে বসে গিয়েছে। ফরাসি কফিশপে আবার ভেতরের চেয়ে বাইরেই ভিড় বেশি। খোলা হাওয়ায় বসে ব্রেকফাস্ট পর্ব মিটিয়ে লোকে অফিস যাবে। কেউ মেট্রোয়, কেউ বাসে। বাসস্টপ এখানে একটাই, বাস রুটও এক। মালাকফের প্লেস দু’গার থেকে পার্ক দ্য স্যাঁ ক্লঁদ, ব্যস। কাছাকাছি একটা গির্জা খুঁজে পাওয়া যায়, আর একদম শেষ প্রান্তে একটা বিশ্ববিদ্যালয়। ইউনিভার্সিটি রেনে দেকার্ত। জানা গেল, সংখ্যাতত্ত্ব আর আইন পড়ানো হয় সেখানে। বেশ নামডাকও আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়েই আমেনের খেলাধুলোর সরঞ্জামের দোকান। কাউন্টার ভর্তি ফ্রান্সের পতাকা-রঙা টুপি আর টেডি বিয়ার। কাঁচাপাকা চুলের ফরাসি বললেন, “কাল খেলা। তার পর ফ্রান্স ফাইনাল খেলবে।” ঠিক জানেন ফাইনাল খেলবে? “হ্যাঁ, হ্যাঁ। দু’গোল দেবে জার্মানিকে!” উপবিষ্টের হতভম্ব মুখচোখ দেখে ভদ্রলোক সস্নেহ ব্যাখ্যায় ঢোকেন, “আমাদের টিমটা দেখুন। তা হলেই বুঝে যাবেন। এত ভাল টিম জার্মানির আছে? আমি তো ফাইনালের টিকিট কেটে রেখেছি!”

এক দিকে ফুটবল-পাগল দোকানদারের ঠিকরে পড়া আত্মবিশ্বাস। আবার এই মালাকফ ঘুরে এমন ফরাসিও পাওয়া যায়, যাঁরা ফাইনালের টিকিট কেটে রাখা দূরস্থান, ফুটবল মাঠেই আর কোনও দিন যাবেন না! সকালে যে হোটেল মালিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনিই তো! ফুটবল তাঁর কাছে আতঙ্ক, দুঃস্বপ্নের প্রতিশব্দ। ২০১৫-র ১৩ নভেম্বর স্তাদ দ্য ফ্রাঁসে ফ্রান্স-জার্মানি ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর ভাই। সস্ত্রীক। হঠাৎ স্টেডিয়ামের পাশে পরপর বিস্ফোরণের শব্দ। খেলা থমকে যায়। দর্শকদের নামিয়ে আনা হয় মাঠে। ড্রেসিংরুমে গোটা রাত আটকে থাকেন ফুটবলাররা। ইসলামিক স্টেটের আত্মঘাতী জঙ্গিদের বোমা-বন্দুকে তছনছ হয়ে যেতে থাকে প্যারিস।

বাড়ি ফিরে দু’রাত ঘুমোতে পারেননি নোয়ার ভাই ও তাঁর স্ত্রী। নোয়া সে দিনই ঠিক করে ফেলেন, এ-ই শেষ। জীবনের যেখানে গ্যারান্টি নেই, সেখানে কীসের ফুটবল? “ভাই স্টেডিয়াম থেকে ফোন করায় বুঝতে পারিনি কী করব। বাড়ি ফিরেও ওরা কাঁপছিল,” বলার সময় গলাটাও কেঁপে যায় তাঁর।

নোয়ার হোটেলেই অস্থায়ী আস্তানা বাঙালি সাংবাদিকের। যার খুব আক্ষেপ হয় নিজের ঘরে ফিরতে-ফিরতে। সত্যিই তো! ‘ইউরো-মেলা’র থেকে দূরে সবুজ ডাকবাক্সেও জমা হয়ে ছিল কত কত চিঠি। পড়ে দেখা হয়নি তো! দেখা হয়নি, ফিকে বারুদগন্ধেও এখনও কেমন তিরতির কাঁপে ছিমছাম শহরতলি। যেখানে বুলেটের কাছে হেরে যাওয়া মন থেকে বরাবরের মতো মুছে যায় ফুটবল!

আর তখনই মনে হয়, ইউরো সেমিফাইনালের প্রিভিউ লিখতে একটা দিন না-ই বা যাওয়া হল শঁজেলিজে। আইফেল টাওয়ার-স্যাঁ দেনিতে বাধ্যতামূলক হত্যে না দিলেও কিচ্ছু যায়-আসে না!

ডাকবাক্সের ‘ঘর হতে’ শুধু দু’পা ফেলে খুঁজতে হয় ছোট্ট এক অশ্রুবিন্দু!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

euro cup football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE