সেই পুরনো মেজাজে ধোনি। আইপিএলে খোয়াজার আত্মপ্রকাশ।
ঝাড়খণ্ডের বাইরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সবচেয়ে বেশি ফ্যান কোথায়?
এত দিন জানতাম না। এ দিন শুনলাম আর স্বচক্ষে প্রমাণ পেলাম, উত্তর হবে নয়াদিল্লি। উইক ডে-তে দিল্লির মাঠে যা ভিড় ছিল, এ যাবত নাকি আগের আইপিএল ম্যাচগুলোয় হয়নি। স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলছিলেন, এটা দিল্লি ভাল খেলছে বলে আজ নয়। স্রেফ ধোনির জন্য।
এমনিতে ফ্র্যাঞ্চাইজি দলে ধোনির অধিষ্ঠান হল পাকিস্তান টিমে আশির দশকের ইমরানের মতো। টিমে কখন কী করবেন কেউ জানে না। টিম ব্যাট করবে না ফিল্ড করবে, প্লেয়াররা টসের পর ড্রেসিংরুমের টিভি দেখে জানে। স্ট্র্যাটেজি মিটিংয়ে থাকেন না। রোজ নেটে যান না। দিল্লিতে তো টিমের সঙ্গে এক হোটেলেও তিনি নেই। রাজধানীতে নাকি তাঁর নিজের বাড়ি রয়েছে। টিম পরপর হারায় তাঁর অধিনায়কত্ব এমন স্ক্রুটিনির মুখে পড়েছে যা ইহজীবনে হয়নি।
কিন্তু এ দিন ধোনি ব্যাট করতে নামার পর কোটলা যে চিৎকারটা তুলল, তা একমাত্র সচিনের জন্য হয়। আর ইদানীং কোহালিকে নিয়ে বেঙ্গালুরু শুরু করেছে। আর দিনগুলো দু’উইকেট পড়ার পর মোটেও নামছিলেন না ধোনি। এখন আর সঞ্জীব গোয়েন্কা সেটা বরদাস্ত করছেন না। ধোনি তাই চারেই এলেন আর পুরনো লোকটার ঝলক দিলেন যার একশো চল্লিশের নীচে স্ট্রাইকরেট নামত না। তাঁর আজকের ২০ বলে ২৭ এবং মহম্মদ শামিকে এক ওভারে নেওয়া ২০ রান ম্যাচের টুকরো অংশ।
আরও প্রভাবশালী কত কিছু ছিল। আজকে রাহানের নিয়ন্ত্রিত ইনিংসে পুণেকে বহু দিন পর সাত উইকেটে ম্যাচ জেতানো। রাহানের আউটফিল্ড থেকে দুর্দান্ত থ্রোয়ে দুমিনিকে রান আউট করা। ব্রেথওয়েটের সেই ইডেন স্মৃতি ফিরিয়ে এনে ৮ বলে ২০ রানে আচমকা থেমে যাওয়া। উসমান খোয়াজার ডরভয়হীন ব্যাটিং। কিন্তু ধোনির মেজাজে ফেরা বোধহয় পুণে-কাহিনির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ! টিমটাই শুধু ভেসে যাচ্ছিল না, ক্যাপ্টেনকে কাঠগড়ায় তুলে ভাসছিল। যা পরাক্রান্ত দিল্লিকে অঘটন ঘটানো হারে খানিকটা জুড়়োল।
ম্যাচে আরও একটা ফ্যাক্টর অন্যতম নির্ণায়ক হিসেবে দেখা দিল। দিল্লির দল নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি।
আইডিয়াটা কার ছিল, অনুমানের ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কিছু না জেনেই আন্দাজ করা যাক, দিল্লি টিমের মেন্টরের। তাঁকে, রাহুল দ্রাবিড়কে এই ধরনের ক্রিকেটীয় চিন্তাভাবনার সঙ্গে সহজেই সম্পর্কিত করতে পারা যায় যে, সাফল্যেও নিরন্তর ঝুঁকি নাও। যাতে পরের রাক্ষুসে চ্যালেঞ্জের সময় বুনিয়াদটা শক্ত থাকে।
নইলে টুর্নামেন্টে এত ভাল খেলতে থাকা ফেভারিট দিল্লি ডেয়ারডেভিলস আজ একই সঙ্গে তিন অপরিহার্য প্লেয়ারকে বিশ্রাম দেবে কেন? টিম লিস্টটা হাতে আসার পর আবিষ্কার করা গেল ক্যাপ্টেন জাহির খান শুধু নন, কুইন্টন ডি’কক নেই। ক্রিস মরিস নেই। আর দিল্লি কি না চার জন স্পিনার খেলাচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে যে ছক নিতে গিয়ে কোটলায় হেরে কেকেআর অধিনায়ক তীব্র সমালোচিত হয়েছিলেন।
এটার একমাত্র ব্যাখ্যা— দিল্লিকে প্লে-অফের অতর্কিত চ্যালেঞ্জের সামনে অভ্যস্ত করানোর চেষ্টা হচ্ছে। পুণে এমন টিম যারা দু’পয়েন্ট পেলে ওপরের দিকের তিনটে টিমের অন্তত কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। বৈপ্লবিক প্লেয়ার পরিবর্তনের লগ্নির জন্য পুণে বা কিংগস ইলেভেন পঞ্জাব জাতীয় বিপক্ষ থাকাই সেরা সুযোগ। আর জাহিররা তাই করলেন।
দুটো টিমের ওজন আর মনোবলের এত তফাত যে, তাতেও দিল্লির বিনা রক্তপাতে লগ্নি হয়ে যাওয়ার কথা। টুর্নামেন্টের সেরা বোলিং লাইন আপ বোধহয় জাহিরদের। কী পেস, কী স্পিন। পুণে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল প্রথমে দুর্দান্ত ফিল্ডিং, তার পর পেশাদারি ব্যাটিংয়ে।
সদ্য ভারতে পৌঁছনো উসমান খোয়াজার পিঠের পেছনে জার্সি নম্বরের নীচে লেখা হয়েছে ‘খাজা’। পুণে টিমে যাঁরা জার্সি করছেন, তাঁরাই হয়তো ভুল করেছেন। মাঠে পৌঁছনোর পর খোয়াজা উষ্মা প্রকাশ করে টুইটও করে দেন, ‘পুণে বোধহয় খাজাকে চাইছিল। আমাকে নয়। আমার ফিরে যাওয়াই ভাল।’ এ দিন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলা প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরনে অবশ্য বোঝালেন— চলে যেতে নয়, শক্ত করতেই এসেছেন।
ডরভয়হীন এই মেজাজটাই পিটারসেন, দু’প্লেসিরা ফ্র্যাঞ্চাইজিকে দিতে পারেননি। খোয়াজা বয়ে আনলেন। কিন্তু পরের বছরের জন্য কি তাঁর আগমন একটু বেশি তাড়াতাড়ি? সময় বলবে।
আইপিএলের এত বড় অঘটনের ম্যাচে দিন্দার দ্বিতীয় ওভার থেকে পুণে স্কোয়াডে একটি ব্যক্তির মুখ মনে পড়ছিল। তিনি টিম মালিক নন, টিমের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট। নাম প্রসন্ন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বিচারে টিমের এক নম্বর ক্রিকেট-উন্মাদ। নিজের সন্তান হওয়ার আগে যিনি বউকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, ছেলে-মেয়ে যা-ই হোক, নাম রাখব সচিন। ছেলে হয়, তার নাম সচিন। কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়। এর পর মেয়ে হয়েছে। তার নাম— লারা। এহেন প্রসন্ন হলেন টিমের পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট। হালফিল ক্রিকেটে এঁরা এত গুরুত্বপূর্ণ যে, গুজরাত লায়ন্সের ছক থেকে কোনও রকমে ভাঙিয়ে প্রসন্নকে পুণেতে আনা হয়েছে। সারা বছর তিনি থাকেন অবশ্য ডে’ভিলিয়ার্সদের সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকান বোর্ড তাঁকে ল্যাপটপ সহ টিমের সঙ্গে রেখে দিয়েছে পারফরম্যান্স অ্যানালিস্ট হিসেবেই।
এহেন প্রসন্ন বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, টিম হারছিল বিপক্ষকে ব্যাটিং পাওয়ার প্লেতে বেশি রান করতে দিয়ে। আর নিজেরা শেষ ছয় ওভারে যথেষ্ট রান তুলতে না পেরে। কী কী স্ট্যাটস, প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোথায় কোথায় বল করতে হবে, কম্পিউটার গ্রাফিক্স-সহ সব পুঙ্খানুপুঙ্খ তিনি পেশ করেছেন। অথচ দুঃখ করছিলেন, কোনও সংশোধন হচ্ছে না। এ দিনও তো পাওয়ার প্লেতে হু-হু করে রান উঠছিল। বোলিং অন্য দিনের তুলনায় সাবধানী হলেও এখনও আশঙ্কার কারণ। অশ্বিন আজও ওভার পিছু আট রান করে দিলেন। দিন্দাও তাই। পুণে ব্যাটিংটা কিন্তু মনে হচ্ছে খোয়াজা এসে যাওয়ায় জমল। আর ধোনি, তিনি তো ফের রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলেন।
পুণে হয়তো সেমিফাইনাল এখনও উঠবে না। কিন্তু শীর্ষ বাছাই দু’একটাকে হারিয়ে যদি এমনই হইচই বাধায়। দু’একটা নামীদামি দলকে খসায়, সেটাই বা খারাপ কী!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ১৬২-৭ (দুমিনি রান আউট ৩৪, করুণ নায়ার ৩২, রজত ভাটিয়া ২-২২), রাইজিং পুণে সুপারজায়ান্টস ১৬৬-৩ (রাহানে ৬৩ নট আউট, খোয়াজা ৩০, ধোনি ২৭, ইমরান তাহির ২-২৬)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy