Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
একান্ত আলাপচারিতায় কোচ শাস্ত্রী: বিদেশ নয়, সবই ঘর

বিরাটের তুলনা হতে পারে শুধু ভিভের সঙ্গেই

দলের ঘোর দুর্যোগের মধ্যে ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়া। ইংল্যান্ডে তখন ভারতীয় দল ১-৩ টেস্ট সিরিজ হেরেছে। তার আগে অস্ট্রেলিয়া ০-৪ হোয়াইটওয়াশ হয়েছে।

মুগ্ধ: কোহালির নেতৃত্বের মুন্সিয়ানায় অভিভূত গুরু শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র

মুগ্ধ: কোহালির নেতৃত্বের মুন্সিয়ানায় অভিভূত গুরু শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯ ০৩:০৫
Share: Save:

দলের ঘোর দুর্যোগের মধ্যে ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেওয়া। ইংল্যান্ডে তখন ভারতীয় দল ১-৩ টেস্ট সিরিজ হেরেছে। তার আগে অস্ট্রেলিয়া ০-৪ হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। সেখান থেকে বিরাট কোহালিদের নতুন ভারতের উদয়। র‌্যাঙ্কিংয়ে সাত নম্বরে পড়ে থাকা একটা দল উঠে এল এক নম্বরে। ব্যাটসম্যান এবং অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহালির উত্থান তাঁরই অধীনে। ইতিমধ্যেই সেরা কিংবদন্তিদের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে বিরাটের। তিনি কী মনে করেন? বর্তমান এই দলের লক্ষ্য কী? ভারতীয় দলের সঙ্গে ২০১৪ থেকে যাত্রা নিয়ে (মাঝখানে কিছু সময়ের জন্য কোচ হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে) মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শহরে তৃতীয় এক দিনের ম্যাচ খেলতে এসে আনন্দবাজারের সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতায় বসেছিলেন ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। আজ সেই আলাপচারিতার শেষ পর্ব:

প্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজে দু’টো টেস্ট সেঞ্চুরি রয়েছে আপনার। মাথার পাশ দিয়ে, মুখের পাশ দিয়ে ক্যারিবিয়ান পেসারদের বলগুলো উড়ে যেতে দেখেছেন। এখন ড্রেসিংরুমে বসে যখন দেখেন ভারতীয় পেসাররা সেই আগুন ফিরিয়ে দিচ্ছে, কেমন লাগে?

শাস্ত্রী: ভীষণই গর্ব হয় দেখে যে, আমি এমন একটা দলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছি, যাদের হাতে বিশ্ব মানের এক ঝাঁক ফাস্ট বোলার রয়েছে। যারা চোদ্দো মাস ধরে ধারাবাহিক ভাবে, অক্লান্ত ভাবে পারফর্ম করে গিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারির রেকর্ড ভেঙেছে। ক্যারিবিয়ান পেসারদের সঙ্গে তুলনা হওয়াটাই বিরল। সেখানে এক ক্যালেন্ডার বর্ষে তাদের শিকার সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাওয়াটা তো অভাবনীয় কীর্তি! পেস বোলিং বিভাগ হিসেবে ওরা কত ভাল করেছে, এই রেকর্ড তার প্রমাণ।

প্র: মহম্মদ শামিকে নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জেতার পরে। কতটা উন্নতি করেছেন শামি?

শাস্ত্রী: সমস্ত ফর্ম্যাট মিলিয়ে দারুণ উন্নতি করেছে। ফিটনেস বাড়িয়ে দারুণ ভাবে ফিরে এসেছে। টেস্ট ক্রিকেটে দুরন্ত বোলিং করেছে, ওয়ান ডে-তে ফিরে এসেছে। কোনও বিশ্রাম না নিয়ে নিউজিল্যান্ডেও দারুণ বল করেছে। গত চার মাসের পারফরম্যান্স দেখলে শামি খুবই ভাল করেছে। তেমনই বলতে হবে বুমরা এবং ইশান্তের কথাও। কৃতিত্বটা পুরো বোলিং বিভাগের। বাকি দু’জনের সমর্থন ছাড়া অন্য জনের সাফল্য সম্ভব ছিল না।

প্র: দায়িত্ব নিয়ে ভারতীয় সহকারী কোচ আনলেন। বিদেশি বিশেষজ্ঞের রেওয়াজ চলছিল তার আগে। বোলিং কোচ বি. অরুণ, ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার, ফিল্ডিং কোচ আর শ্রীধর। তাঁরাই এখন ফুল ফোটাচ্ছেন।

শাস্ত্রী: আমি ভারতীয় কোচ না বিদেশি, এ ভাবে ব্যাপারটাকে দেখিনি। আমি দেখেছিলাম, কাদের সঙ্গে কাজ করতে ছেলেরা স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। কোন কোচেদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে ছেলেরা। আমি ভারতীয় ক্রিকেট সিস্টেম থেকে কোচেদের নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। যারা আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক বছর ধরে পড়ে থেকে সফল হচ্ছে। যারা প্রত্যেক অঞ্চলের প্রতিভাসম্পন্ন ছেলেদের চেনে। আজকের এই টিমটায় যারা খেলছে, আমাদের কোচেরা তাদেরকে ছোটবেলা থেকে দেখছে। তাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠতে দেখেছে। প্রথম থেকেই তাই একটা স্বচ্ছন্দ ভাব তৈরি হয়ে গিয়েছে ছেলেদের সঙ্গে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় কখনও বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা নেই।

প্র: তরুণ প্রতিভাদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেছেন বরাবর। কী ক্যাপ্টেন হিসেবে, কী কোচের ভূমিকায়। ঋষভ পন্থ, পৃথ্বী শ, বিজয় শঙ্করদের আগমন নিয়ে কী বলবেন?

শাস্ত্রী: আমি তরুণদের সঙ্গে কাজ করতে ভালবাসি। ওদের চোখের দিকে তাকালে ভয়ডরহীন তরঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায়। ওরা অজানা প্রতিভা। সেখান থেকে তারকা হয়, ঘরে-ঘরে ওদের নাম পৌঁছে যায়। তখন পরীক্ষা হচ্ছে, চাপের মুখে সফল হওয়া। সব মিলিয়ে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার মতো ব্যাপার। তার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারলে দারুণ অভিজ্ঞতা। এই বিবর্তনের সেরা উদাহরণ? বিরাট কোহালি।

প্র: কোহালি কতটা উন্নতি করেছেন? ক্রিকেটার হিসেবে, অধিনায়ক হিসেবে?

শাস্ত্রী: যত কম বলার চেষ্টা করা যায়, ততই ভাল। কারণ, আমরা এ বার বিশেষণ হারিয়ে ফেলছি। অসাধারণ! অসাধারণ! অসাধারণ! ব্যাটসম্যান হিসেবে, উদাহরণ হিসেবে, নেতা হিসেবে। নতুন অভিধানই লিখে দিচ্ছে ও।

প্র: অস্ট্রেলিয়ায় চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি। সেটাই পাল্টে দিল বিরাটকে?

শাস্ত্রী: একদমই তাই। তার আগে ইংল্যান্ড সফরটা ওর ভাল যায়নি। তাই অস্ট্রেলিয়ায় একটা বড় সিরিজ চেয়েছিল বিরাট। চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি। এর চেয়ে বড় তো আর কেউ কখনও করে দেখাতে পারেনি। তার পর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বিরাটকে। সব জায়গায়, সব পরিস্থিতিতে রান করে দেখাচ্ছে। এটাই ‘গ্রেটেস্ট’দের নমুনা। একমাত্র কাঁটা হয়ে বিঁধছিল ইংল্যান্ড। ওখানে আগের সফরে রান পায়নি। এ বার গিয়ে ছ’শোর উপর করল। বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের এক জন হিসেবে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্টিত করে ফেলেছে বিরাট। খেলতে খেলতেই সেটা করে ফেলল ও। এর পরে যদি আর একটাও ম্যাচ না খেলে, তা হলেও সর্বকালের সেরাদের তালিকায় থেকে যাবে বিরাট কোহালির নাম।

প্র: আলোচনা চলছে কোথায় গিয়ে থামবেন বিরাট?

শাস্ত্রী: থামবে না। একেবারেই থামবে না। ওকে থামাতে চাইছেন কেন? (ড্রেসিংরুমের বারান্দা থেকে কোহালি সেঞ্চুরি করার পরে যে ভাবে হাত নেড়ে ব্যাট করে যেতে বলেন হেড কোচ, সেই ভঙ্গি করলেন)। তিরিশ বছরের একটা ছেলে যখন একচল্লিশ ওয়ান ডে সেঞ্চুরি, পঁচিশটা টেস্ট সেঞ্চুরি করে ফেলে, তাকে কেউ থামতে বলে না। তাকে বলে তুমি খেলে যাও আর আমরা তোমার ব্যাটিং উপভোগ করতে থাকি।

প্র: সেরা কিংবদন্তির সঙ্গে তুলনা হচ্ছে কোহালির। আপনার কী মত?

শাস্ত্রী: বিরাটকে দেখলে আমার একটাই তুলনা মাথায় আসে। ভিভ রিচার্ডস। যে ভাবে বিরাট বোলিংকে শাসন করে, তা দেখে আমার ভিভকেই মনে পড়ে। ভিভের মতোই মাঠে নেমেই বোলারদের চোখে চোখ রেখে তাদের শাসন করার জন্য তৈরি। এবং, সেটা সব ধরনের ক্রিকেটে, বিশ্বের সর্বত্র গিয়ে সব রকম পরিবেশে। আইসিসি পুরস্কারের সব ক’টাই জিতে নিয়ে গেল। মনে হয় না এটা আর কখনও কেউ করতে পারবে বলে। একে তো টেস্ট এবং ওয়ান ডে দু’টোতেই সেরা ব্যাটসম্যান। তার উপর দুই ধরনের ক্রিকেটে সেরা ক্যাপ্টেনও। এটাও প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে, এই টিমটা কত ভাল খেলেছে। লোকে আমাকে প্রশ্ন করছে, টিম কেমন খেলছে? আমি তাদের বলছি, আইসিসি পুরস্কারের তালিকাটা দেখে নাও না এক বার। উত্তর পেয়ে যাবে। ক্রিকেটার বিরাটের ট্রফিগুলো যেমন ওর উৎকর্ষের পুরস্কার, তেমনই সেরা অধিনায়ক হিসেবে সেরার স্বীকৃতি পাওয়াটা দল হিসেবে সাফল্যের পুরস্কার।

প্র: ক্যাপ্টেন কোহালির সমালোচনা কম হয়নি। আপনি কী বলবেন? কেমন অধিনায়ক কোহালি?

শাস্ত্রী: বিরাট এখনও খুবই তরুণ। তিরিশ বছর বয়স। আরও ভাল এবং ভাল হতে থাকবে। ইতিমধ্যেই রেকর্ড বলছে, ভারতের সফলতম ক্যাপ্টেন বিরাট। তা হলে প্রশ্নের জায়গা থাকছে কোথায়? ইতিমধ্যেই যদি ও ভারতের সেরা ক্যাপ্টেন হয়, তা হলে যারা বলে ও ভাল ক্যাপ্টেন নয়, তাদের কী বলা যেতে পারে? তা হলে আমি তাদের থেকে একটু শিখে নিতে চাই, ভাল ক্যাপ্টেন কাকে বলে এবং কারা সেই ভাল ক্যাপ্টেন?

প্র: আগে বলা হত ভারত শুধু নিজেদের দেশের মাটিতে ভাল খেলা একটা দল। এই দল বিদেশে সাফল্য পাওয়াকে কতটটা গুরুত্ব দিতে চায়?

শাস্ত্রী: তালিকার সব চেয়ে উপরে থাকছে এটাই। সেই কারণেই বিদেশে খেলতে নেমে আমরা কখনও অভিযোগ, অনুযোগ করি না। পিচ বা পরিবেশ নিয়ে কখনও কান্নাকাটি করতে শুনেছেন এই দলকে? কখনও দেখবেন না। এই দলটা অজুহাত দিতে পছন্দ করে না। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে, দেশ-বিদেশ এই সীমারেখাটাকে মুছে ফেলা। আমরা হোম-অ্যাওয়ে ভাবনাটাকেই ভুলে যেতে চাইছি। ওয়াংখেড়েতে খেলতে নামলে যে রকম মনোভাব থাকবে, ওয়ান্ডারার্সেও তা-ই। দিল্লিতে যে রকম ডাকাবুকো দেখাবে, ডারবানেও যেন তা দেখা যায়। বৃহত্তর লক্ষ্যটা হচ্ছে— এমন ক্রিকেট খেলো যাতে ‘অ্যাওয়ে’ বা বিদেশ ভাবনাটাই উড়িয়ে দেওয়া যায়। যেখানেই খেলতে নামো, সেটা তোমার ঘর। এই দল সেটাই করে দেখাতে চাইছে।

প্র: বিশ্বকাপ নিয়ে ছেলেদের কী বার্তা দেবেন?

শাস্ত্রী: এখনই সেটাতে ঢুকতে চাই না। এই সিরিজ শেষ হয়ে গেলে ছেলেদের বলব, যে মরসুমটা কাটিয়ে এলে, তার সাফল্য উপভোগ করো। বিশ্বকাপের তিন সপ্তাহ আগে আমাদের আবার দেখা হবে। তখন আমরা কথা বলব সামনের মিশন নিয়ে। মিশন বিশ্বকাপ নিয়ে। (শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE