Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
জেতাতে না পারলে হয়তো ক্রিকেটই ছেড়ে দিতাম: ব্রেথওয়েট

বাইশ গজের বাইরেও স্যামিদের স্পর্ধায় দিশেহারা বিশ্ব

ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়তে-ছাড়তে ইডেন পিচের দিকে ছুটে যাচ্ছেন ডোয়েন ব্র্যাভো, পাগলের মতো ডেকে নিচ্ছেন গোটা টিমকে। ওটা কী? ‘রেগে’ ডান্স না? একশোয় আপনি দু’শো। ইডেন বাইশ গজে এখন নাচ চলছে। কাপ-জয়ের নাচ। মার্লন স্যামুয়েলসকে থামানো যাচ্ছে না। সাংবাদিক সম্মেলন করছেন প্যাড পরে, সামনের ডেস্কে পায়ের উপর পা তুলে বসে! শেন ওয়ার্নকে সহ্য হচ্ছে না। আজ বারবার মনে পড়ছে।

ইডেনে স্যামুয়েলসের সাংবাদিক সম্মেলন।

ইডেনে স্যামুয়েলসের সাংবাদিক সম্মেলন।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১০
Share: Save:

ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়তে-ছাড়তে ইডেন পিচের দিকে ছুটে যাচ্ছেন ডোয়েন ব্র্যাভো, পাগলের মতো ডেকে নিচ্ছেন গোটা টিমকে। ওটা কী? ‘রেগে’ ডান্স না? একশোয় আপনি দু’শো। ইডেন বাইশ গজে এখন নাচ চলছে। কাপ-জয়ের নাচ।

মার্লন স্যামুয়েলসকে থামানো যাচ্ছে না। সাংবাদিক সম্মেলন করছেন প্যাড পরে, সামনের ডেস্কে পায়ের উপর পা তুলে বসে! শেন ওয়ার্নকে সহ্য হচ্ছে না। আজ বারবার মনে পড়ছে। বেন স্টোকস, তাঁরও বা রেহাই কোথায়? ম্যাচ শেষে যে ভাবে ইংরেজ ডাগআউটের দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন স্যামুয়েলস, সিমন্স দৌড়ে এসে না আটকালে কেলেঙ্কারি হত। তাতেও অবশ্য পুরোপুরি রেহাই মেলেনি। তিরিশ পার্সেন্ট ম্যাচ ফি গচ্চা গিয়েছে। লক্ষ্যবস্তু সহজ, স্টোকস!

ব্রেথওয়েট, কার্লোস ব্রেথওয়েট, তিনি কোথায়? ওই যে তিনি, ইডেন গ্যালারির ‘বি’ ব্লকের জালের ঠিক সামনে। গ্লাভস জোড়া একে একে খুলে ছুড়ে দিচ্ছেন গ্যালারিকে। চার ছক্কার মহানায়ক উন্মত্ত আহ্বান জানাচ্ছেন গোটা ইডেনকে মাঠে নেমে আসতে!

ডারেন স্যামি লজ্জিত। ডারেন স্যামির প্রবল লজ্জা হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের কথা ভাবলে। করুণা হচ্ছে, মার্ক নিকোলাসের কথা ভাবলে। নিকোলাসই বলেছিলেন না, ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট আদতে ‘ক্রিকেট উইথ নো ব্রেনস’? “জানেন একটা সময় আমাদের ইউনিফর্ম নিয়ে পর্যন্ত সমস্যায় পড়তে হয়েছে,” বলতে বলতে ক্যারিবিয়ান কাঠিন্যও ঝাপসা হয় চোখের জলে। “ওই নিকোলাস বলেছিল, আমাদের ক্রিকেটে নাকি মগজ নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড তো একটা খোঁজও নিল না। ছিঃ,” বিশ্বজয়ী স্যামির গলায় জয়োচ্ছ্বাস কোথায়, এ তো হাহাকার!

রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটা, মাত্র আধ ঘণ্টায় গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে গেল ডারেন স্যামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আবেগে। বিস্ফোরণে। মাঠে কার্লোস ব্রেথওয়েট চার ‘বোমায়’ ইংরেজ-বধ করে থাকলে, মাঠের বাইরে যা চলল তার পাশে যথাযথ বিশেষণ স্রেফ একটা বসতে পারে।

কার্পেট বম্বিং!

যে ক্যারিবিয়ান বোমাবাজিতে একে একে উড়ে গেলেন শেন ওয়ার্ন থেকে বেন স্টোকস। উড়ে গেলেন মার্ক নিকোলাস থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের মহাকর্তা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মহাকাব্যিক জয়ের পর ইডেনের হিংস্র চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল, ডারেন স্যামি নন। বিশ্বজয়ী অধিনায়কের নাম আজ বোধহয় মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আবেগের অকুন্ঠ প্রদর্শনে, উদাত্ত জঙ্গি সমর্থনে, বা ‘গুড বাই ইংল্যান্ড’ কোটি ডেসিবেলের চিৎকারে, রবিবার রাতের ইডেন একবারও বুঝতে দেয়নি মাঠে আজ ভারত ছিল না। এবং ম্যাচ পরবর্তী দৃশ্য দেখার পর যে কোনও ক্রিকেট-সাংবাদিক ভাবার চেষ্টা করবে, মাঠের ছবিতে এই। ম্যাচ শেষের ইডেন ক্যারিবিয়ান হুঙ্কার দেখলে আজ উন্মত্ততার কোন মানদণ্ড নিজের জন্য রাখত?

ভাবা যায়, মার্লন স্যামুয়েলস দশ মিনিটের সাংবাদিক সম্মেলনে এক বারও ডেস্ক থেকে পা নামালেন না! সাংবাদিককুল আপত্তি তুলবে কী, বিস্ময়ে চোয়াল ততক্ষণে ঝুলে গিয়েছে। পাশে দাঁড়ানো আইসিসি মিডিয়া কর্তা বিদ্যুৎপৃষ্ট। কেউ আপত্তি করলেও যে ক্যারিবিয়ান নায়ক তাতে ন্যূনতম পাত্তা দিতেন, মনে হয় না। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মিডিয়ার দিকে ততক্ষণে ধেয়ে এসেছে, “আর ইউ কমফর্টেবল?” পরের দশ মিনিটে ও সব নিয়ে ভাবার পর্যাপ্ত সময়ও থাকল না। কারণ শুরুতেই লাভাস্রোতের মুখ খুলে দিলেন স্যামুয়েলস।

কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে স্টোকস কেন? স্যামুয়েলস চিবিয়ে উত্তর দেন, “আরে ছেলেটা বড় বেশি কথা বলে। বারবার বলেছি, খেলার সময় আমার সঙ্গে কথা বলবি না! তবু বলে যাচ্ছিল। দেখলি তো শেষে কী হল!” আর ওয়ার্ন? তিনি কী দোষ করলেন? এ বার যেন আরও বেড়ে গেল ক্যারিবিয়ান স্পর্ধা। “ওই আর এক জন। শেন। গত চার বছর ধরে দেখছি অস্ট্রেলিয়ায় গেলেই নানা ছুতোনাতায় আমার পিছনে পড়ে যায়। জানি না ওর কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা আমার সঙ্গে আছে কি না,” বলে আবার দ্রুত নুনের ছিটে, “আসলে হয়তো আমার মুখটা আসল, ওরটা নয়, তাই! যাক গে, আমার ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা ওর জন্য!” যেন একই সঙ্গে দু’জনকে একটা কমন বার্তা দিয়ে রাখা, বন্ধুরা ভবিষ্যতে আমার পিছনে লাগতে এসো না। নইলে পরের পর পুরস্কারগুলো তোমাদের জন্য তোলা থাকবে!

এত পর্যন্ত পড়লে মনে হবে, ম্যাচ পরবর্তী অংশের পুরোটাই বোধহয় ‘প্রতিশোধের’ আগুনে ক্রিকেটবিশ্বকে পুড়িয়ে দেওয়া। প্রাক্-টুর্নামেন্টের ক্রমাগত অপমানের উত্তর। কিন্তু সেটা আংশিক সত্যি। ক্যারিবিয়ান গর্বের পূর্ণ ক্যানভাসে যেমন আগুন থাকল, ঠিক তেমনই থাকল অপরিমিত রোম্যান্স।

নইলে কার্লোস ব্রেথওয়েটকে আপনি কী বলবেন? যিনি ঠিক করে ফেলেছেন, বিশ্বজয়ের ব্যাটটা ইহজীবনে হাতছাড়া করবেন না। রাতে ড্রেসিংরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে নায়ক বলছিলেন, “এটা আমার নিজেকে নিজের দেওয়া সেরা উপহার। ঠিক করে ফেলেছিলাম, শেষ ওভারে যা হোক মারতেই হবে। আমরা আগেও এ সব জায়গা থেকে ম্যাচ বার করেছি। হোক না বিশ্বকাপ ফাইনাল, আফটার অল একটা ম্যাচই তো।” পরে যেটা বললেন, আরও আকর্ষক। “জানি না টিম হেরে গেলে কী হত। জানি না আমি কী করতাম। কে জানে, হয়তো ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিতাম!”

কথাবার্তায় শুষ্কং-কাষ্ঠং মনুষ্য চরিত্রেরও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়া উচিত। যাক গে, দৃশ্যপটে ব্রেথওয়েট সরলেন, ব্র্যাভো ঢুকলেন। যাঁকে নিজের মোবাইল ধরিয়ে গেইল বলছেন, “একটা ছবি তুলে দাও। দিস ওয়ান ইজ ফর মম।” কার্টলে অ্যামব্রোজকে দেখা গেল টিভি ক্যামেরার সামনে। তিনটে আঙুল নাচাচ্ছেন। অর্থাৎ, একটা নয়। আমাদের এখন তিন-তিনটে বিশ্বকাপ। রবিবার দু’টো। তৃতীয়টা এ বছরই, অনূর্ধ্ব উনিশ। এবং রাত বারোটা নাগাদ ইডেন ড্রেসিংরুমে বিখ্যাত সেই গানটা আবার বাজানো শুরু হল। মধ্যমণি অবশ্যই ডিজে ব্র্যাভো, তাঁকে ঘিরে গোটা টিম।

যা শুনলে মনে হবে, শুধু ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট কেন, এটা তো অনায়াসে রবিবাসরীয় ইডেনের গানও হতে পারে। যে ইডেন যাবতীয় আশঙ্কা উড়িয়ে ঊনত্রিশ বছর আগের কাপ ফাইনালের জনসংখ্যার স্মৃতি মনে পড়িয়েছে। ঊনত্রিশ বছর আগে কপিল-হীন ইডেন ফাঁকা ছিল না। ঊনত্রিশ বছর পরেও বিরাট-হীন ইডেন বিষাদে ডুবে থাকল না।

ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট তো বটেই, ড্রেসিংরুমের ব্র্যাভো-সৃষ্ট গানটা আজ ইডেনের জন্যও বরাদ্দ হওয়া উচিত। অন্তত ক্রিকেট-স্পিরিটের বিচারে।

চ্যাম্পিয়ন...চ্যাম্পিয়ন...!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Samuels Carlos Brathwaite quit wt20
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE