মিরপুরে বিধ্বংসী উমর আকমল।
এল ক্লাসিকো শুরু হওয়ার ঠিক সাড়ে সাত ঘণ্টা আগে শেষ হয়ে গেল ক্রিকেটের এল ক্লাসিকো!
অন্তত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কখনওই এল ক্লাসিকোয় উন্নীত নয়। সেটা হওয়ার জন্য ম্যাচটা কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপে পাক বনাম অজি হতে হবে। একটা টিমকে বার্সা আর একটা টিমকে রিয়াল আরও বেশি করে লাগবে, যদি টস হেরে বা জিতে, পাকিস্তান প্রথম ব্যাট করে। অ্যাসেজের সূচনা হয়েছিল ১৮৭৭ সালে ওভালে। ক্রিকেটের এল ক্লাসিকোর সূচনা ২০০৯ সালে একটা পুঁচকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। যার নাম সেন্ট লুসিয়া।
ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ধারে সে দিন ১৯১ করে পাকিস্তান হেরে গেছিল। পদ্মাপারে তারা সার্থক বদলা নিল একই স্কোর করেও ১৬ রানে ম্যাচ জিতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন নিয়মকানুন এত ব্যাটসম্যানদের পক্ষে বদলেছে। পাওয়ার হিটিংয়ের মান এত উঁচু। আর গড়পড়তা ব্যাটসম্যানদের চেহারাগুলো এত তাগড়াই যে এক-একটা ম্যাচ অবিশ্বাস্য স্তরে উঠে যাচ্ছে। দু’শো রান করেও স্পিন সহায় উইকেটে সাদা চামড়ার টিমের বিরুদ্ধে নিরাপদ থাকা যাচ্ছে না। আর টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও এত অনবরত সংঘর্ষ চলছে যে, চল্লিশ ওভার শেষ হওয়ার পর মনে হচ্ছে বুঝি দর্শক নব্বই ওভার সারা দিনের খেলা দেখে উঠল!
খেলা শুরুর ঘণ্টাখানেক আগে দেখা হয়ে গেল শোয়েব আখতারের সঙ্গে। শোয়েবকে ভাষ্যকার হিসেবে বিশ্ব ক্রিকেট এই প্রথম দেখছে। কিন্তু নিজের দেশে ক্রিকেট বিশ্লেষক হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে উঠছেন। ভারতের যেমন সিধু। পাকিস্তানে তেমনই শোয়েব। পর্দায় এলেই টিআরপি। শোয়েবের আবার এমন রেকর্ড আছে যা সিধুরও নেই। শোয়েব একদিন অসুস্থ অবস্থায় অ্যাম্বুল্যান্সে হসপিটাল যাচ্ছিলেন। সেখানে জরুরি হয়ে পড়ায় অ্যাম্বুল্যান্স থেকে বাইট দিয়েছেন। তা এ হেন ফাস্ট বোলার লাঞ্চে রুই মাছ ভাজার কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, “পাকিস্তান হয়ে এল। আর টুর্নামেন্টের শেষ ক’দিন। এই টিম দিয়ে চলবে না। নেতৃত্ব শক্তিশালী না হলে যা হয়।”
হবু শ্বশুর আব্দুল কাদির
একা শোয়েব কেন, অনেকেরই তীব্র ধারণা ছিল আজ হেরে লাহৌর এয়ারপোর্টের টম্যাটো সাপ্লায়ারদের সজাগ করে দেবে হাফিজের পাকিস্তান! কে জানত, আব্দুল কাদিরের জামাইয়ের মাধ্যমে তারা এমন লড়াই দেবে যা এক সময় তাদের ক্রিকেটের বিশেষত্ব ছিল।
কাদিরকে মনে আছে তো? সাতষট্টি টেস্টে ২৩৬ উইকেট। এখনও যাঁর সম্পর্কে ইমরান স্তুতিতে গদগদ, “কাদিরের আমলে এখনকার মতো লেগস্পিনারকে ফ্রন্টফুটে এলবিডব্লিউ দেওয়ার রেওয়াজ থাকলে ওয়ার্নকে নিয়ে এই নাচানাচিটা আপনারা করতেন না।” তাঁর মেয়ের সঙ্গে আগামী মাসে শাদি হতে যাচ্ছে উমর আকমলের। শাদির তোফার আগে রোববারের মিরপুর অবশ্য উমরের জন্য বয়ে আনল ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার। তাঁর এ দিনের ৫৪ বলে ৯৪ দেখার পর ক্রিকেটের সুশীল সমাজে আলোচনা শুরু হয়ে গেল, কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে কোনও পাকিস্তানির সেরা ইনিংস এটাই কি না? আফ্রিদি—পাকিস্তান ব্যাটিংয়ের প্রধান ভরসা তখনও উদিতই হননি। হলেন অতিথি শিল্পীর মতো চার ওভার বাকি থাকতে। কিন্তু তাঁর অভাব যে বুঝতেই দেননি উমর আকমল।
পয়েন্ট তালিকায় ততক্ষণে পাকিস্তানকে হৃত সম্মান ফিরে পেতে দেখে ফেলেছে সবাই। একমাত্র খটকা—যদি অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটিংয়ের ‘টু ডব্লিউ’ মারকাটারি করে দেন। ওয়ার্নার আর ওয়াটসন। গত কয়েক মাস ধরে এঁরা বিপক্ষকে নিয়ে কী করছেন দেখার জন্য গুগলে একটা ক্লিক মারলেই চলবে। তা সে ‘ডব্লিউ’ ভাইয়েরা কিনা আউট হয়ে গেলেন প্রথম ওভারেই। অবিশ্বাস্য যে পাকিস্তান প্রথম ওভারে কার্যত অচেনা জুলফিকর বাবরকে দিয়ে এ সব ঘটিয়ে ফেলল। ক্যামেরা তখন প্যান করছে ডাগআউটে ডারেন লেম্যানের ওপর। প্রোফাইলে বিশ্বের এক নম্বর ক্রিকেট কোচ তিনি! টি-টোয়েন্টিতে তা হলে কী তৈরি করলেন দলকে?
উমরের উচ্ছ্বাস। মিরপুরে।
এই সময়েই গ্লেন ম্যাক্সওয়েল তাঁর জাদু শুরু করে দিলেন। অস্ট্রেলিয়া দু’উইকেটে ৮ নয়, দুই ‘ডব্লিউ’-কে হারিয়ে ৮। এমন আইসিসিইউ পরিস্থিতি থেকে পাক স্পিনারদের এমন মারতে শুরু করলেন যেন তিনি ছদ্মবেশী আফ্রিদি। ম্যাক্সওয়েল নন। মাত্র ১৮ বলে ৫০ এমন ভাবে হল যেন ক্রিকেটে ডট বলের কোনও বিধান নেই। প্রত্যেকটা বলের শুধুই চার বা ছয় হওয়া উচিত! তাঁর ৩৩ বলে মিরপুরের ৭৪ দেখে উপমহাদেশে একজনের উদ্বেলিত হয়ে যাওয়া উচিত। তিনি পঞ্জাবের মালকিন প্রীতি জিন্টা। আজকের ইনিংসটা আইপিএল নিলামের আগে খেলা হলে নিলামে এ বার ম্যাক্সওয়েলের দাম এক কোটিতে কিছুতেই আটকাত না।
ইনিংসটা অস্ট্রেলিয়াকে জেতাতে পারল না বাকি মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায়। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়াম এবং বিশ্ব টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে ঢুকে গেল। ম্যাক্সওয়েলকে যে যুগ্ম ম্যান অব দ্য ম্যাচ দেওয়া হল না, এটা ঢাকার ট্র্যাফিকের মতোই অসহ্য!
ছবি: এএফপি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy