Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

বন্যেরা বনে সুন্দর, মেসির হাতে ব্যালন ডি’অর

এল ক্লাসিকো-র ইতিহাসে সম্ভবত চিরস্মরণীয় ম্যাচটা সোমবার প্রায় ভোরে টিভিতে দেখে উঠে হঠাৎ-ই মাস দুই আগের একটা ছবি মনে পড়ছিল! মঞ্চে পেলের হাত থেকে রোনাল্ডো ব্যালন ডি’অর পুরস্কারটা নেওয়ার মুহূর্তে দর্শকাসনে প্রথম সারিতে বসা মেসি-র ভাবলেশহীন মুখটা! টানা চার বারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার দেখছে, বিশ্ব ফুটবলে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে চলে গেল ট্রফি!

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:৪০
Share: Save:

বার্সেলোনা-৪ (ইনিয়েস্তা, মেসি-হ্যাটট্রিক-২টি পেনাল্টি-সহ)

রিয়াল মাদ্রিদ-৩ (বেঞ্জিমা-২, রোনাল্ডো-পেনাল্টি)

এল ক্লাসিকো-র ইতিহাসে সম্ভবত চিরস্মরণীয় ম্যাচটা সোমবার প্রায় ভোরে টিভিতে দেখে উঠে হঠাৎ-ই মাস দুই আগের একটা ছবি মনে পড়ছিল! মঞ্চে পেলের হাত থেকে রোনাল্ডো ব্যালন ডি’অর পুরস্কারটা নেওয়ার মুহূর্তে দর্শকাসনে প্রথম সারিতে বসা মেসি-র ভাবলেশহীন মুখটা! টানা চার বারের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার দেখছে, বিশ্ব ফুটবলে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে চলে গেল ট্রফি!

সে দিনই কি মেসি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, মাঠে এর জবাব দেবে? গোটা ফুটবলদুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে, ব্যালন ডি’অর যতই রোনাল্ডোর ট্রফি ক্যাবিনেটে শোভা পাক, তার আসল মালিক কে? জানুয়ারির ব্যালন ডি’অর পুরস্কার অনুষ্ঠানের পর প্রথম এল ক্লাসিকো-টা গত রাতেই ছিল। আর সেই মহামঞ্চে রিয়াল মাদ্রিদের ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সুনাম, যশ, প্রতিপত্তি সব ধুলোয় মিশিয়েই শুধু দেয়নি লিওনেল মেসি, আমার মতে ফিফার বর্ষসেরা বাছার সিদ্ধান্ত নিয়েও যেন প্রশ্ন তুলে দিল! আরে বাবা, তুমি যদি আসল যুদ্ধে, সত্যিকারের পরীক্ষাতেই সফল হতে না পারো, তা হলে কীসের চ্যাম্পিয়ন? কীসের তুমি বিশ্বের সেরা ফুটবলার?

অনেকে বলতে পারেন, পরিসংখ্যান তো দেখাচ্ছে এ মরসুমে মেসির চেয়ে রোনাল্ডো বেশি ধারাবাহিক। বেশি গোল করেছে। রিয়াল তো বত্রিশটা (তার মধ্যে ছাব্বিশটা জয়ী) ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর মোটে একটা হারল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বত্রিশ ম্যাচ আগে রোনাল্ডোরা শেষ যে ম্যাচ হেরেছিল সেটাও ছিল একটা এল ক্লাসিকো-ই।

এ মরসুমে আবার এল ক্লাসিকো-এ জোড়ায়-জোড়ায় মহারথীদের যুদ্ধ। মেসির পাশে নেইমার, তো রোনাল্ডোর সঙ্গী গ্যারেথ বেল। চার জনই গত রাতে শুরু থেকে মাঠে ছিল। নেইমার (কুড়ি মিনিট আগে বসে যায়) ছাড়া বাকি তিন মেগাস্টার ফুটবলারই পুরো ম্যাচ খেলেছে। সব মিলিয়ে চার জনের পারফরম্যান্সে আমি সবচেয়ে কম নম্বর দেব রোনাল্ডোকে। দশে পাঁচ। সবচেয়ে বেশি পাবে মেসি। দশে নয়। নেইমার আর বেল পাবে সমানদশে সাত।

রোনাল্ডো ম্যাচের শুরুতেই রকেট গতিতে বার্সেলোনা ডিফেন্সে বিপজ্জনক ভাবে ঢুকে পড়া আর একটা বিতর্কিত পেনাল্টি আদায় করে তার থেকে গোল করা বাদে তেমন কিছুই করেনি, যার জন্য ওকে এই মহাযুদ্ধে আলাদা ভাবে মনে রাখতে হবে। বরং বেল দ্বিতীয়ার্ধে দুর্ধর্ষ একক দৌড়ে বার্সা ডিফেন্সকে তছনছ করে বেঞ্জিমাকে যে অসাধারণ পাসটা দিয়েছিল, সেটা অবধারিত গোল ছিল, যদি না গোলকিপার ভালদেস অসাধারণ একটা নিচু সেভ করত।

বেচারা বেঞ্জিমা! প্রথমার্ধেই ওর হ্যাটট্রিক হয়ে যায়। কিন্তু তার বদলে ওকে বিপক্ষের মেসির ঐতিহাসিক হ্যাটট্রিক দেখতে হল। যে হ্যাটট্রিকে মেসি এল ক্লাসিকো-এ রিয়ালেরই সর্বকালের কিংবদন্তি দি’স্তেফানোর সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ভাঙল। মেসি-ম্যাজিক শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত কিন্তু ম্যাচটা বেঞ্জিমারই ছিল। যতই কি না ছ’মিনিটেই বার্সার লেফট ব্যাক অঞ্চল থেকে টানা তেইশটা পাস খেলার পর শেষ পর্যন্ত মেসির ফাইনাল পাস থেকে ইনিয়েস্তা বার্সাকে ১-০ এগিয়ে দিল! এই স্কোরলাইটাকে মিনিট কুড়ির মধ্যে মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে বেঞ্জিমা ২-১ করে দিয়েছিল। দি’মারিয়ার দু’টো অসাধারণ মুভের পর দুটো ততটাই অনবদ্য পাস থেকে। যদিও রিয়ালের দুটো গোলের সময়ই বার্সার এ মরসুমের নড়বড়ে ডিফেন্সের জলজ্যান্ত প্রমাণ পিকে-মাসচেরানোর মধ্যে তীব্র বোঝাপড়ার অভাব। কয়েক মিনিট বাদেই অবশ্য পিকে ‘পাপে’র প্রায়শ্চিত্ব করে বেঞ্জিমার অবধারিত ‘হ্যাটট্রিক’ গোললাইন সেভ করে। মেসির অনবদ্য পারফরম্যান্স মনে রেখেও বলব, প্রথমার্ধে ওই সময় রিয়াল ৩-১ এগিয়ে গেলে হয়তো ম্যাচ রিপোর্ট অন্য ভাবে লিখতে হত।

তার বদলে হাফটাইমের ঠিক আগে নেইমারের সঙ্গে চোখধাঁধানো ওয়ান-টু খেলে মেসিই ২-২ করে দিয়ে বরং ম্যাচের রং পাল্টে দিল। তিন জন ডিফেন্ডারের আড়ালে থেকেও গোলে অনবদ্য প্লেসিং করল মেসি। অথচ এই সে দিনও পুরো ফিট ছিল না ছেলেটা! তবে এই গোলটার রাস্তা তৈরি করা আর দ্বিতীয়ার্ধে রিয়াল বক্সে তাকে সের্জিও র্যামোসের ফাউল করতে বাধ্য করে পেনাল্টি আদায় করার মধ্যে নেইমারের দুর্দান্ত ট্যাকটিক্যাল গেমপ্ল্যান আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রথম ক্ষেত্রে নেইমার বলটাকে এমন ভাবে ডিফেন্ডারের ট্যাকলের থেকে বাঁচিয়ে হোল্ড করে মেসিকে ফাইনাল পাসটা বাড়িয়েছিল, দেখবার মতো! আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পেনাল্টি আদায় করল দুর্দান্ত বল কন্ট্রোল আর শরীরের ভারসাম্যে র্যামোসের থেকে আগে চলে গিয়ে। ওই অবস্থায় নিজের বক্সে ডিফেন্ডারের প্রতিপক্ষকে মারা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। হয় তাকে গোল করতে দাও, নয়তো পিছন থেকে মারো। র্যামোস পরেরটাই করেছে, যদি পরে পেনাল্টিটা গোলকিপার লোপেজ বাঁচাতে পারে! নেইমারের এই ট্যাকটিক্যাল বুদ্ধিমত্তা বিশ্বকাপে ব্রাজিলেরও বাড়তি শক্তি হয়ে উঠবে।

৩-৩-এর পরেও নাটক বাকি ছিল। রিয়াল দু’বার (২-১ আর ৩-২) এগিয়ে থেকেও ম্যাচটা হারল! শুধু দ্বিতীয়ার্ধেই তিন-তিনটে পেনাল্টি কিকে গোল। শেষেরটা আবার বার্সার জয়সূচক আর মেসির হ্যাটট্রিক গোল। ইনিয়েস্তাকে বক্সের মধ্যে ট্রিপ করেছিল জাবি আলোন্সো। আসলে ততক্ষণে ম্যাচের গতিবিধি বার্সার পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। র্যামোসের মতো ডিফেন্ডার লাল কার্ড দেখায় মিনিট পঁচিশ রিয়াল শুধু দশ জনেই খেলেনি, কোচ আন্সেলোত্তি ডিফেন্স সামলাতে বাধ্য হয়ে বেঞ্জিমাকে বসিয়ে ভারানেকে নামানোয় রিয়াল আক্রমণ পুরো ভোঁতা হয়ে যায়। দি’মারিয়া-মদরিচের অসাধারণ খেলাতেও সেই কামড় তৈরি হয়নি। এখানেই দরকার ছিল রোনাল্ডোর নেতৃত্বের। বাড়তি দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে দলকে লিড করা। বিশ্বসেরারা যেমনটা করে থাকে।

কিন্তু মেসি যে এই ম্যাচটায় বুঝিয়ে দিতে নেমেছিল, দ্যাখো সবাই, ব্যালন ডি’অর কার হাতে ঠিক মানায়!

(ছবি গেটি ইমেজেস)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE