Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কস্তার প্রেমে কাশীপুরের রাজা

এই মিষ্টি নিয়ে বিশদে বলার আগে পঞ্চকোট রাজবংশ সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নিই। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন মানভূমের রাকাব পরগনার কেশরগড় থেকে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কাশীপুরে।

ছবি: সুজিত মাহাতো।

ছবি: সুজিত মাহাতো।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩৫
Share: Save:

ছানা, খোওয়া (ক্ষীর), বেসন, ময়দা ( বা আটা)-র মিশ্রণে এলাচ, জায়ফল, জইত্রি, কাজু,

কিসমিস মেশাতে হবে। চিনি খুব কম। এ বার ওই মিশ্রণ লম্বা টানা দানার মতো আকার দিয়ে

খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভেজে নিতে হবে। এই লম্বা টানা দানা দেখতে অনেকটা সরু নিখুঁতির মতো,

বা গোল গাঠিয়ার মতো। ভাজা দানা রসে ভিজিয়ে নরম করে লাড্ডুর মতো পাকিয়ে নিতে হবে।

কাশীপুরের রাজা জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেও শিকার করতে ভালবাসতেন। জঙ্গলে মশার কামড়, জলকষ্ট যদিও বা সহ্য হয়, কিন্তু মিষ্টিপ্রিয় রাজার রসনা যেন বশ মানে না কিছুতেই। এমন একটা মিষ্টি যদি পাওয়া যেত, যেটা বেশ কিছুদিন রেখে দেওয়া যায়, তাহলে সঙ্গে আনতাম বেঁধে—প্রায়ই মনে-মনে ভাবেন রাজা। রাজ পরিবারের ভিয়েনের কানে যখন উঠল সেই কথা, তখন রাজার জন্য উত্তরপ্রদেশের বেনারস থেকে বিশেষ এক ঘিয়ে ভাজা লাড্ডুর রেসিপি শিখে এলেন তিনি। আর এই ভাবেই উত্তর ভারতের ‘কস্তার মিঠাই’ ঢুকে পড়ল মানভূমের ইতিহাসে।

এই মিষ্টি নিয়ে বিশদে বলার আগে পঞ্চকোট রাজবংশ সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নিই। ১৮৩২ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন মানভূমের রাকাব পরগনার কেশরগড় থেকে পঞ্চকোট রাজবংশের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কাশীপুরে। এই রাজবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি জ্যোতিপ্রসাদ সিংহ দেওয়ের অভিষেক ১৯০১ সালে। এই রাজ্যের জমিদারি সেই সময় মানভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও রাঁচি জেলায় বিস্তৃত ছিল। মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ কটক জেলার অন্তর্গত ডালিজোড়া জমিদারি কিনে নিয়ে তার সীমানা আরও বাড়ান। এই ডালিজোড়া জমিদারি এলাকাটি ছিল ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। আজও এই এলাকার বেশ কিছুটা এলাকাতে ঘন জঙ্গল রয়েছে। রাজত্ব বাড়ানোর পরে নতুন জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া ছিল মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদের অন্যতম শখ। বছরে একাধিকবার শিকারে যেতেন তিনি। যখন যেতেন, টানা বেশ কয়েকদিন জঙ্গলেই থাকতেন। জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার মতো মিষ্টি পাওয়ার বাসনাটা সেই সময়ের। একদিন রাজপরিবারের মোদককে ডেকে রাজা বললেন, ‘ওহে, এমন মিষ্টি বানাতে পারো, যেটা জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যাবে এবং বেশ কয়েকদিন ধরে খাওয়াও যাবে?’

মিষ্টান্ন প্রিয় রাজার রসনা তৃপ্তির কথা ভেবে যে লাড্ডু বানানো হল—নাম কস্তার লাড্ডু বা কস্তার মিঠাই। রাজ পরিবারের ভিয়েন বংশের বর্তমান উত্তরসূরি জনার্দন দাস মোদকের কথায়, ‘‘উত্তরপ্রদেশের বেনারসে আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা থাকেন। তাঁদের মিষ্টির ব্যবসা রয়েছে। সেখান থেকে রেসিপি জেনে এসে বাবা তৈরি করেছিলেন ওই লাড্ডু। দেখতে একটু লালচে। খেতে অপূর্ব।. দু-তিন দিন নয়, অন্তত দিন পনেরো বেশ ভাল থাকবে।’’ জঙ্গলে শিকারে গিয়ে সেই মিষ্টির প্রেমে পড়লেন রাজা। তাঁর সেই মিষ্টি খেয়ে এতটাই ভাল লাগল যে ফিরে এসে আরও বানানোর অর্ডার দিলেন।

পঞ্চকোট রাজবংশের এক সদস্য সোমেশ্বর লাল সিংহ দেও জানান, রাজবাড়িতে বিজয়ার মিষ্টিমুখে এই লাড্ডু প্রজাদের বিলি করতেন রাজা। লাড্ডু তৈরির সময় গাওয়া ঘিয়ের গন্ধে এলাকা ম-ম করত।

সেই রাজতন্ত্র কবে বিদায় নিয়েছে। রাজাও নেই, আর সে রাজত্বও নেই। সেই সঙ্গে কালের গর্ভে উধাও হয়েছে কস্তার সেই স্বাদ। কাশীপুরের দু-একটি দোকানে এখনও কস্তা পাওয়া যায় বটে। কিন্তু না সেই গন্ধ-না সেই স্বাদ। এক মিষ্টি দোকানির কথায়, ‘‘পুরনো সেই স্বাদের কস্তার লাড্ডু বানাতে যে খরচ পড়বে, তার মূল্য দিয়ে কেনার মতো লোক কই এখানে?’’

কিন্তু এত যার চাহিদা, তাকে চেপে রাখাও কঠিন। পঞ্চকোট রাজের হারিয়ে যাওয়া কস্তার সেই স্বাদ তাই ফিরিয়ে আনছে রাজ্য সরকারের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের অধীনস্থ পুরুলিয়ার মানভূম সমবায় দুগ্ধ উৎপাদক সঙ্ঘ লিমিটেড। সমবায়ের পরিচালন অধিকর্তা পীযূষ রায় বলেন, ‘‘এই লাড্ডুটি মানভূম তথা পঞ্চকোট রাজ-পরিবারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। এটা অন্য কোথাও মেলে না। এর রেসিপি কাশীপুর এলাকাতে পুরনো দিনের কয়েকজন জানতেন শুধু। তাঁদের কাছ থেকে রেসিপি জেনে আমরা ওই মিষ্টি ফিরিয়ে এনেছি।’’

পুরনো দিনের মিষ্টি নতুন প্রজন্মের মন ভোলাতে পারবে কি না, সেটা বলবে সময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE