Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মমতা অনড়, রাজ্য থেকে বিদায়ের পথে ইনফোসিস

এ রাজ্যে ইনফোসিসের ক্যাম্পাস তৈরির শেষ চেষ্টাও ভেস্তে গিয়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর অনড় মনোভাবে হতাশ ইনফোসিস এ বার জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। এমনকী, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকল্প নাকচ করার ঘোষণাও করে দিতে চায় তারা। গত সোমবার, ৫ জানুয়ারি, বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের তিন দিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন ইনফোসিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রামদাস কামাথ।

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১১
Share: Save:

এ রাজ্যে ইনফোসিসের ক্যাম্পাস তৈরির শেষ চেষ্টাও ভেস্তে গিয়েছে।

স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর অনড় মনোভাবে হতাশ ইনফোসিস এ বার জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। এমনকী, আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকল্প নাকচ করার ঘোষণাও করে দিতে চায় তারা।

গত সোমবার, ৫ জানুয়ারি, বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটের তিন দিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন ইনফোসিসের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট রামদাস কামাথ। মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি জানান, এ রাজ্যে ক্যাম্পাস তৈরিতে তাঁর সংস্থা খুবই আগ্রহী। কিন্তু সে জন্য বিশেষ আর্থিক অঞ্চল (এসইজেড) যে একান্ত জরুরি, সে কথাও একই সঙ্গে ফের জানিয়ে দেন তিনি। সূত্রের খবর, এ কথা শোনার পরেই কার্যত আলোচনা থামিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কামাথের মুখের উপরেই বলে দেন, এ বিষয়ে আর কোনও কথা হবে না।

ইনফোসিস সূত্রের খবর, গত ৪ জানুয়ারি রাজারহাটে জমি দেখতে যান রামদাস কামাথ। বিশ্ব জুড়ে সংস্থার বিভিন্ন ক্যাম্পাস-সহ অন্যান্য পরিকাঠামোর দায়িত্বে থাকা কামাথ রাজারহাটের ৫০ একর জমি দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এসইজেড তকমা পেলে এখানে এখনই কাজ শুরু করে দিতে চান বলেও ঘনিষ্ঠ মহলে জানান তিনি।

তার পরের দিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে রাজ্য সরকারের উচ্চপদস্থ আমলাদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলেন কামাথ। গোড়ায় হিডকো-কর্তা দেবাশিস সেন, তার পর মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। সব আলোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একমাত্র মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই বিশেষ আর্থিক অঞ্চলের জট ছাড়তে পারে। কিন্তু ইনফোসিসের আশায় জল ঢেলে দেন মুখ্যমন্ত্রী।

অথচ, মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘ফাটাফাটি’ বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের একমাত্র যে উল্লেখ ছিল, সেটা হল বাম আমলে ছাড়পত্র পাওয়া টিসিএস-এর এসইজেড ক্যাম্পাস। সম্মেলনে উপস্থিত টিসিএস-কর্তা নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে পরিচয় করে দেওয়ার সময় শিল্প তথা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অমিত মিত্র এই ক্যাম্পাসে ৪০ হাজার কর্মসংস্থানের কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রীও রাজ্যের সাফল্যের খতিয়ানে উল্লেখ করেন টিসিএস-এর ওই প্রকল্পের কথা। কিন্তু একই সঙ্গে ইনফোসিসের নাম না-করে মমতা জানিয়ে দেন, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণেই এসইজেড অনুমোদন করবে না তাঁর সরকার। তবে এসইজেডের তকমা ছাড়াই কেন্দ্র কোনও প্রকল্পকে সমতুল সুবিধা দিলে তাঁর আপত্তি নেই।

মুখ্যমন্ত্রীর এই দু’রকম বক্তব্যকে সরকারের দ্বিচারিতা হিসেবেই দেখছে শিল্পমহল। তাদের দাবি, বাম আমলে আসা টিসিএসের এসইজেড-ই বেঙ্গল গ্লোবাল সামিটে রাজ্যের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের মুখ রক্ষা করেছে। এই সম্মেলনে মোট দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে বলে সরকারের তরফে দাবি করা হলেও তার মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান এক পয়সাও নয়। যদিও এ রাজ্যে বলার মতো শিল্প বলতে এখন একমাত্র তথ্যপ্রযুক্তিই। এই পরিস্থিতিতে ইনফোসিসের প্রকল্পকে এসইজেড তকমা দিতে অস্বীকার করে মুখ্যমন্ত্রী কার্যত তার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছেন। তাতে আখেরে ক্ষতি রাজ্যেরই।

প্রসঙ্গত, ৫ তারিখ সংস্থার বার্ষিক পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের জন্য ইনফোসিসের শীর্ষ কর্তারা কলকাতায় হাজির ছিলেন। কামাথ ছাড়াও ছিলেন সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ নারায়ণ মূর্তি, সিইও বিশাল সিক্কা অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কৃশ গোপালকৃষ্ণন, প্রাক্তন সিএফও মোহনদাস পাই প্রমুখ। কিন্তু এই তারকা সমাবেশের এক জনও শিল্প সম্মেলনে যোগ দেননি। আসেননি উইপ্রো বা কগনিজেন্টের মতো তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কোনও কর্তাও।

এ রাজ্যে ইনফোসিসের বিনিয়োগ প্রথম থেকেই পদে পদে বাধা পেয়েছে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতায় এসে নারায়ণমূর্তি জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে চান তিনি। ৫০০ কোটি টাকা লগ্নি ও ৫ হাজার জনের কর্মসংস্থানের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রকল্পের জন্য ১০০ একর জমি সরকারের কাছে চায় তারা। কিন্তু দাম নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালের শেষে ৭৫ কোটি টাকার বিনিময়ে ৫০ একর জমি দেওয়া হয় সংস্থাকে।

কিন্তু মমতার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে এসইজেড তকমা নিয়ে তৈরি হয় সংশয়। ২০১১-র নভেম্বরে জমি হাতে পাওয়ার আগেই ইনফোসিসের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, কলকাতার প্রকল্প আপাতত স্থগিত রাখছে তারা। এর পরে ২০১২ সালের অগস্টে জমির লিজ দলিল চায় সংস্থা। স্থগিত হওয়া প্রকল্পে ক্ষীণ আশার আলো দেখা যায়। পরের মাসেই বেঙ্গালুরু যান তৎকালীন শিল্প তথা তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ইনফোসিসের তৎকালীন এগ্জিকিউটিভ কো-চেয়ারম্যান কৃশ গোপালকৃষ্ণন ও সংস্থার অন্য কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি জানান, রাজ্য সরকারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে চায় ইনফোসিস।

কিন্তু সেই বৈঠকের পরেই গোটা বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়। কারণ এসইজেড-এর সমান লাভজনক বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারেনি রাজ্য। অন্য দিকে, বিশ্ব বাজারে মন্দার জন্য সম্প্রসারণ নিয়ে তেমন আগ্রহ ইনফোসিসেরও ছিল না। ফলে জমি হাতে থাকলেও একটি ইটও গাঁথা হয়নি। আর কখনও হবে কি না, সেটাই সন্দেহ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sez infosys gargi guhathakurta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE