কাশ্মীরের সিআরপি জওয়ানদের কনভয়ে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে ফেসবুকে নিজস্ব বক্তব্য পোস্ট করেছিল আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রীটি। ছবি: রয়টার্স।
আধ ঘণ্টার কথোপকথনে ওড়না মুড়ি-দেওয়া মাথাটা নামিয়ে রাখলেন সারা ক্ষণ। মাঝেমধ্যেই ফুঁপিয়ে কান্না। শুক্রবার রাতের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বারবার কেঁপে উঠছেন বিরাটির ফেসবুক-কাণ্ডে ধৃত নাবালিকার মা।
শনিবার দুপুরে হাজার অনুরোধ সত্ত্বেও ঘর থেকে বেরোননি মেয়েটির বাবা আর দাদা। মুখ লুকোচ্ছেন কেন? মা বললেন, ‘‘লজ্জায়।’’ ঘর ভাঙচুর, মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে অশালীন মন্তব্য, অনভিপ্রেত ফোনের বন্যা, রাতভর আতঙ্কের প্রহর কাটানোর পরে চা-বিক্রেতা গৃহকর্তার পরিবারটি আতঙ্কে আপাতত ঘরবন্দি।
কাশ্মীরের সিআরপি জওয়ানদের কনভয়ে জঙ্গি হামলার প্রেক্ষিতে ফেসবুকে নিজস্ব বক্তব্য পোস্ট করেছিল আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রীটি। মা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এক মহিলা প্রথমে তাঁদের বাড়ি এসে ওই পোস্টের কথা তুলে মেয়েটিকে শাসাতে থাকেন। মা তাঁকে বলেন, ‘‘সকলের সঙ্গে মেয়ের চিন্তাধারা তো না-ও মিলতে পারে!’’ তাতে কান না-দিয়ে মহিলা তখনকার মতো চলে যান। ঘণ্টাখানেক পরে খড়দহে একটি কাজে বেরিয়ে যান মা। মাঝপথে তিনি খবর পান, মেয়ে ঘরে নেই! সোশ্যাল মিডিয়ায় হুমকির জেরে ঘর ছেড়েছে সে।
আরও পড়ুন: পুলওয়ামায় শান্তির কথা বলে ধর্ষণের হুমকি পেলেন বারাসতের মহিলা
তার পর? বেলঘরিয়া, দমদম, শিয়ালদহ, বিরাটি স্টেশনে উদভ্রান্তের মতো মেয়েকে খুঁজতে থাকেন তিনি। বসিরহাটে পরিচিতদের বাড়ি মেয়ে যেতে পারে, এই অনুমানে হাসনাবাদগামী ট্রেনে উঠে পড়েন। রাত ১২টা নাগাদ বসিরহাটে নেমে দেখেন, স্টেশনে বসে রয়েছে বছর সতেরোর কন্যা। মায়ের কথায়, ‘‘আমাকে দেখামাত্র হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘আমি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় কত কিছু লিখি। কখনও তো এমন কিছু হয়নি!’ এরই মধ্যে ওর বাবা ফোনে জানাল, বাড়িতে ভাঙচুর হচ্ছে। পরিচিতদের বাড়ি গেলে কে কী বলবে, সেই ভেবে রাতে মেয়েকে নিয়ে স্টেশনেই রয়ে গেলাম। সারা রাত দু’জন দু’জনকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে ছিলাম। যাতে কেউ দেখতে না পায়, সে জন্য আড়ালে বসে ছিলাম।’’ ভোরে বসিরহাট থেকে প্রথম ট্রেন ধরে বিরাটি পৌঁছে নিমতা থানায় যান মা ও মেয়ে। ব্যারাকপুর সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০১, ৫০৪, ৫০৫ এবং ৩৪ নম্বর ধারায় কিশোরীকে গ্রেফতার করা হয়। নাবালিকা হওয়ায় আপাতত তাকে হোমে রাখা হয়েছে।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা সম্পর্কে এই তথ্যগুলি জানেন?
আরও পড়ুন: ওটি-তেই নীরবতা পালন, শুয়ে রোগী
কিশোরীর গ্রেফতারে আপত্তি জানিয়ে শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এখন একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, যখন মানুষ যুক্তিবাদী মন দিয়ে কিছু ভাবতে পারছে না। মেয়েটির বাড়ি ভাঙচুর, গ্রেফতার সমর্থন করি না।’’ স্থানীয় সিপিএম বিধায়ক তন্ময় ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘মেয়েটির মতামত নিয়ে বিতর্ক হতে পারত। কিন্তু তার বাড়িতে গুন্ডামি প্রদর্শন স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের শামিল। পুলিশ কৌশলগত ভাবে বলতেই পারে, নিরাপত্তার খাতিরে মেয়েটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সেটিও গণতান্ত্রিক যুক্তি নয়।’’ আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কিশোরী ফেসবুকে যা লিখেছে, তাতে মানহানির কিছু ঘটেনি। প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ফলে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই এ ক্ষেত্রে খাটে না।’’ জয়ন্তবাবুর মতে, ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে একটি বাদে সব ক’টি অভিযোগই জামিনযোগ্য। তার সুরক্ষার স্বার্থে ওই একটি ধারাতেও জামিন দিয়ে তাকে পরিবারের কাছে পাঠানো যেত। হোমে পাঠানোটাই বরং খারাপ হয়েছে।
ঘটনাটি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। আর ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার সুনীলকুমার চৌধুরীর দাবি, ‘‘জনতার আবেগে আঘাত লাগায় এলাকার কয়েক জন বাসিন্দার অভিযোগের ভিত্তিতে নাবালিকাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy