Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Crime

কেন কেড়ে নিল প্রাণটা...

শুক্রবার সকালে ডিভিসির সেচখাল থেকে বালকের হাত-পা দেহ উদ্ধারের পরে, শুধু পরিবার নয়, সারা গ্রামের রোষ গিয়ে পড়ে অভিযুক্তদের উপরে।

আকুল: সান্ত্বনাদেবীকে সামলাচ্ছেন পরিজন, পড়শিরা। ইনসেটে, সন্দীপ। নিজস্ব চিত্র

আকুল: সান্ত্বনাদেবীকে সামলাচ্ছেন পরিজন, পড়শিরা। ইনসেটে, সন্দীপ। নিজস্ব চিত্র

কাজল মির্জা
গলসি শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৫:৫০
Share: Save:

কোলের কাছে বসিয়ে ছেলেকে দুধ-মুড়ি খাওয়ান। মায়ের আদর খেয়ে ঠাকুমার কাছে যায় নাতি। মনসা মন্দিরের সামনে বাজি ফাটানোর আব্দার ফেলতে পারেননি বৃদ্ধা। ঠাকুমার দেওয়া ১০ টাকা নিয়েই বাড়ি থেকে বেরোয় সে। প্রায় দেড় দিন পরে, ওই বাড়িতেই ফিরল বছর নয়ের সন্দীপ দলুইয়ের দেহ।

শুক্রবার সকালে ডিভিসির সেচখাল থেকে বালকের হাত-পা দেহ উদ্ধারের পরে, শুধু পরিবার নয়, সারা গ্রামের রোষ গিয়ে পড়ে অভিযুক্তদের উপরে। মা সান্ত্বনা দলুইয়ের অবশ্য কোনও দিকে হুঁশ নেই। বারান্দায় ঠায় বসে কেঁদে যাচ্ছেন তিনি। জ্ঞান হারাচ্ছেন বারবার। তাঁকে ঘিরে রেখেছেন পরিজন, প্রতিবেশীরা। কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ করে সান্ত্বনাদেবীর চিৎকার, ‘‘হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিল। মেরে ফেলার আগে কী নির্যাতন হয়েছে আমার ছেলের উপরে। ছেলেটা বাঁচার জন্য জলে ছটফট করেছে...।”

পরিজনেরা জানান, মোবাইলে গেম খেলার নেশা ছিল সন্দীপের। বাড়িতে তেমন ফোন না থাকায় দিনের বেশির ভাগ সময় পাড়ার যুবক জয়ন্ত বাগের কাছে ঘোরাঘুরি করত সে। জয়ন্ত গ্রিল-মিস্ত্রি। লোহা ঝালাইয়ের সময় মাঝেমধ্যে সন্দীপকে রড ধরে সাহায্য করতে বলত সে। তার বিনিময়ে মোবাইলে গেম খেলতে দিত সন্দীপকে। পুলিশের দাবি, জয়ন্তই মোটরবাইকে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সন্দীপকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, সন্দীপ নিখোঁজ হওয়ার পরে, রাতে জয়ন্তকে এলাকায় দেখা গিয়েছে। সন্দীপের বাড়িতেও গিয়েছিল সে। বাদশাও বৃহস্পতিবার গ্রামবাসীদের সঙ্গে খোঁজাখুঁজি করেছে, থানায় যায় বলে দাবি তাঁদের। পুলিশের দাবি, তদন্তে জানা গিয়েছে ঘটনার মূল পাণ্ডা জয়ন্ত। সে বন্ধু বাদশা ও পিসতুতো ভাই মঙ্গলদীপকে নিয়ে এই কাণ্ড ঘটায়।

এ দিন সকালে দেহ উদ্ধারের পরে গ্রামবাসীদের একাংশের রোষ গিয়ে পড়ে ধৃতদের বাড়ির উপরে। পুলিশের দাবি, ওই তিন পরিবারের সদস্যেরা আগেই গ্রামছাড়া হয়ে যান। বাঁশ, শাবল দিয়ে ভাঙচুর চলে বাদশার নির্মীয়মাণ বাড়িতে। ভেঙে দেওয়া হয় পাকা ছাদ, দেওয়ালের একাংশ। জয়ন্তর বাড়ি, মোটরবাইকেও চলে ভাঙচুর। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় প্রায় সমস্ত আসবাব। দলুই পরিবারের প্রতিবেশি জয়দেব মাঝি, দীপা মাঝিরা বলেন, “ন’বছরের একটা ছেলেকে খুন করে দিল! ওদের চরম শাস্তি চাই।”

সাঁকো গ্রামের মেটেপাড়ায় ৭০টি পরিবারের বাস। বেশির ভাগই খেতমজুর। প্রায় সবার বাড়ি কাঁচা। মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। তবে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পের টাকা পেয়ে বাড়ি পাকা করেছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত পঞ্চায়েত বোর্ডে গলসি ২ পঞ্চায়েত সমিতির মৎস্য ও প্রাণী দফতরের কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন সন্দীপের বাবা বুদ্ধদেব দলুই। এ বার সাঁকো পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য তিনি। তাঁরও খড়ের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি। স্থানীয় লোকজনের দাবি, বুদ্ধবাবুর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। স্বামী-স্ত্রী মাঠে কাজ করেই সংসার চালান। এমন পরিবারের ছেলে অপহরণ করে খুনের ঘটনা, মানতে পারছেন না তাঁরা। গ্রামবাসী কপিলদেব রায়, আজাহারউদ্দিন শেখরা বলেন, “অনেক রাজনৈতিক দলের প্রভাব রয়েছে গ্রামে। কিন্তু এমন ঘটনা কখনও দেখিনি।’’

তৃণমূল অবশ্য বিজেপি যোগ দেখছে ঘটনায়। সাঁকো পঞ্চায়েতের প্রধান মহম্মদ আলি মোল্লা বলেন, “জয়ন্ত গত লোকসভা ভোটে বিজেপির বুথ এজেন্ট ছিলেন। আর বাদশা ও বাবু দু’জনেই বিজেপির সমর্থক। তাই আমাদের অনুমান রাজনৈতিক কারণেই বুদ্ধর ছেলে খুন হয়েছে।” তৃণমূলের ব্লক সহ সভাপতি (গলসি ২) শৈলেন হালদারেরও দাবি, “বুদ্ধদেবের সক্রিয়তার জন্য বিজেপি সে ভাবে ওই পাড়াতে সংগঠন গড়তে পারছিল না।’’ যদিও বিজেপি অভিযোগ মানেনি। বুদ্ধদেববাবুও বলেন, “আমার অবস্থা সবাই জানে। তার পরেও চেনা লোক কেন এমন কাণ্ড ঘটাল, বুঝতে পারছি না!’’

সান্ত্বনাদেবী বলেন, ‘‘পুজোর দিনে সব ছেলেরা আনন্দ করছিল। ঠাকুমার দেওয়া টাকা নিয়ে আমার ছেলেটাও ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। রাত হলেও ভেবেছিলাম, মন্দিরতলাতেই আছে। কিন্তু ফোনটা আসায় সব গোলমাল হয়ে গেল।’’ তাঁর দাবি, ‘‘ছেলের জন্য ৩৫ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলাম ওদের। শুনল না। মেরেই ফেলল ছেলেটাকে!।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Murder TMC BJP DVC Canal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE