Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বছরে দু’টাকা দক্ষিণা নেন আউশগ্রামের এই শিক্ষক

সুজিতবাবু শুধু বলেন, ‘‘সবাইকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা শিক্ষকের দায়িত্ব। তা পুঁথিগত হোক, বা সামাজিক। দায়িত্ব পালন না করলে নিজেকে শিক্ষক বলব কী ভাবে!”

মাস্টারমশাই: পড়ুয়াদের সঙ্গে সুজিত চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

মাস্টারমশাই: পড়ুয়াদের সঙ্গে সুজিত চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
আউশগ্রাম শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৯ ০৩:৪১
Share: Save:

পঁচাত্তর বছরে পৌঁছেও পড়ানোয় ছুটি নেননি ‘মাস্টারমশাই’। তাঁর শর্ত একটাই— দক্ষিণা দিতে হবে বছরে দু’টাকা। সে দক্ষিণার সবটাই তিনি খরচ করেন পড়ুয়াদের পিছনে।

পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের উত্তর রামনগরের অশীতিপর শিক্ষক সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের ‘সদাই ফকিরের পাঠশালায়’ আপাতত তিনশোর বেশি পড়ুয়া রয়েছে। বেশির ভাগই জনজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ছাত্রী প্রায় ৮০ শতাংশ।

মাধ্যমিক স্তরে বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস এবং উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরে বাংলা পড়ান তিনি। সঙ্গে গত পাঁচ বছর ধরে সাহায্য করেন থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের। বছরে এক বার থ্যালাসেমিয়া নির্ণায়ক শিবিরও করেন। মাস্টারমশাইয়ের নাম শুনলে জোড়হাত মাথায় ঠেকান আশপাশের বহু গ্রামের বাসিন্দা। তাঁদের মধ্যে মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন রয়েছেন, রয়েছেন বহু অভিভাবকও। ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে তাঁর কাছে এখনও পড়তে আসে অনেকে।

পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু হয় সকাল সাড়ে ৭টায়। তিন ধাপে পড়ানো শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায়। হয় ‘রোল কল’। দু’দিন কোনও পড়ুয়া না এলেই কেন সে আসছে না খোঁজ নিতে বেরোন এই শিক্ষক। দাদু- মেয়ে-নাতি— তিন প্রজন্ম তাঁর কাছে পড়েছে এমন নজিরও রয়েছে।

সুজিতবাবু শুধু বলেন, ‘‘সবাইকে শিক্ষার আলোয় নিয়ে আসা শিক্ষকের দায়িত্ব। তা পুঁথিগত হোক, বা সামাজিক। দায়িত্ব পালন না করলে নিজেকে শিক্ষক বলব কী ভাবে!”

১৯৬৫ সালে গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা জীবন শুরু বাংলায় স্নাতকোত্তর এই শিক্ষকের। স্কুল ছুটির পরে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের ‘বিশেষ ক্লাস’ নিতেন। স্কুল জীবনের শেষ দিকে স্থানীয় জনজাতি পরিবারগুলির শিশু ও কিশোরদের স্কুলমুখী করার জন্য উৎসাহিত করতে শুরু করেন। ২০০৪ সালে স্কুল থেকে অবসর নিয়ে বাড়িতেই শুরু করেন পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের পড়ানো। পেনশনের টাকার একাংশ খরচ করে পড়ুয়াদের বই-খাতা কিনে দেন।

প্রথম দিকে বিনা পারিশ্রমিকেই পড়াতেন। পড়ুয়াদের প্রণামই ছিল গুরুদক্ষিণা। পরে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের সাহায্যের জন্য বছরে এক টাকা ‘দক্ষিণা’ নেওয়া শুরু করেন। হাসিমুখে বৃদ্ধ শিক্ষক বলেন, ‘‘বাজার আগুন। এখন তাই দক্ষিণা বেড়ে হয়েছে দু’টাকা।’’ বছর খানেক আগে এক থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত ছাত্রের ক্যানসারও ধরা পড়েছে। প্রতি মাসে তার কলকাতা যাতায়াতের জন্যও সাহায্য করেন ‘মাস্টারমশাই’।

ছেলে সরকারি কর্মী, মেয়ে শিক্ষিকা। বাড়িতে আছেন স্ত্রী ও অন্য ভাইদের যৌথ পরিবার। স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ছাত্র-ছাত্রী করেই জীবন কেটে গেল ওঁর। কী করে সংসার চলে, খেয়াল করেননি। ওঁকে অনেক বার বলেছি, ‘একটু বেশি টাকাও তো নিতে পার’। জবাব পেয়েছি, ‘তা হলে আর শিক্ষক হলাম কিসের?’ আর কথা বাড়াইনি।’’

এ বছর ‘পাঠশালা’র পড়ুয়াদের মধ্যে মাধ্যমিকে ৫১ জন ও উচ্চ মাধ্যমিকে ১১৬ জন পরীক্ষা দিয়েছিল। অনেকেই ৬০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ আউশগ্রামের দোলচাঁদা খাতুন, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হেঁদেগোড়ার মাম্পি বিশ্বাসদের কথায়, “পড়ার পাশাপাশি, মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে সমাজের পাশে দাঁড়াতেও শিখছি।’’ ভুঁইরা গ্রামের যমজ বোন কৃষ্ণপ্রিয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া মেটে গুসকরা কলেজে পড়ছেন। তাঁরা বলেন, “জীবনে মাস্টারমশাইয়ের স্নেহস্পর্শ না পেলে পড়াশোনা তো দূর, জঙ্গলে কাঠ কুড়িয়ে হয়তো জীবন কাটত।’’

আক্ষরিক অর্থে এই বনস্পতি ছায়া দেন। এখনও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Teacher Bardhaman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE