সাপের সঙ্গেই ঘর-বসত মুবারকের। ছবি: শৈলেন সরকার।
রাতবিরেতে ডাক পড়লেই ঝাঁপি হাতে ছুটে যান তিনি। পলক ফেলার আগেই দু’হাতের কৌশলে বিষধর সাপকে ঝাঁপিতে পুরে ফেলতে পারেন তিনি। তা সে গোখরো হোক বা কেউটে। সেই সাপ নিয়ে সোজা চলে যান নিজের আস্তানায়। কম্বল মুড়ে কাচের বাক্সে রেখে শুরু হয় শুশ্রুষা। সুস্থ হওয়ার পরে সাপেদের মাইথন অথবা পাঞ্চেতের জঙ্গলে ছেড়ে দেন মুবারক আনসারি।
পাঞ্চেত এলাকার বাসিন্দা মুবারকের বিশ্বাস, সাপেরা এখন খুব বিপন্ন। কারণ, তাদের দেখা মাত্রই মেরে ফেলা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, সাপের ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষা করা যতটা জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি মানুষের মার থেকে সাপেদের রক্ষা করা। কারণ, সাপকে রক্ষা করতে না পারলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবেনা। তাই প্রায় ২০ বছর ধরে এই দু’টি কাজ এক সঙ্গে করে চলেছেন তিনি। সরকারি সাহায্য ছাড়াই পরিবেশ ও সাপ বাঁচাতে নিজের বাড়িতেই সর্প সংরক্ষণ কেন্দ্র বা স্নেক পার্ক গড়ে তুলেছেন তিনি। বাংলার সীমানা শহর আসানসোল থেকে পুরুলিয়ার নানা এলাকা বা ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ— সর্বত্রই মুবারকের যাতায়াত। বনাধিকারিক থেকে পুলিশ বা অন্য কোনও সরকারি আধিকারিক, সাপ ধরার দরকার পড়লে এই অঞ্চলে সকলেই মুবারককে ডেকে পাঠান। ডাক পেলেই তিনি পৌঁছে যান গন্তব্যে। সে জন্য কোনও পারিশ্রমিক তিনি নেন না। বরং, গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে মোটরবাইক ছুটিয়ে চলে যান ঘটনাস্থলে।
মুবারক জানান, তাঁর কাজের পিছনে একটিই উদ্দেশ্য, সাপ মারা থেকে মানুষকে বিরত রাখা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি প্রত্যেককেই আবেদন করছি, সাপ না মেরে আমাকে খবর দিন। আমি ধরে নিয়ে যাব।’’ তিনি জানান, একমাত্র ঘরে সাপ ঢুকলে বা কুয়োয় পড়লেই তিনি সাপ ধরতে যান। বাগান বা বাড়ির আশপাশের জঙ্গল থেকে কখনও সাপ ধরেন না। বনবাংলো, সরকারি দফতর, বিভিন্ন ভ্রমণকেন্দ্রের আবাসন বা গৃহস্থালী থেকে এখনও পর্যন্ত কয়েকশো সাপ তিনি ধরেছেন। নিজের সর্প সংরক্ষণ কেন্দ্রে দিন কয়েক রেখে পরে সেগুলি সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে নিয়ে মাইথন বা পাঞ্চেতের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন।
তাঁর ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল, এখন সেখানে রয়েছে গোখরো, কেউটে, শাঁখামুটি, চন্দ্রবোড়ার মতো নানা প্রজাতির প্রায় তিরিশটি সাপ। প্রত্যেকটির সঙ্গেই তাঁর দারুণ বন্ধুত্ব। গলায়, কাঁধে পেঁচিয়ে নানা কসরতও করেন তাদের নিয়ে। পাঞ্চেত, মাইথন বা গড়পঞ্চকোটে বেড়াতে আসা মানুষজন তাঁর এখানে ঘুরে যান। তাঁদের সাপ দেখানোর ফাঁকে মুবারকের একটাই আবেদন, ‘‘দয়া করে সাপ মারবেন না। এরা নিরীহ জীব। এদের আঘাত না করলে কোনও ক্ষতি করে না।’’ জানা গেল, কুলটি ও গড় পঞ্চকোটের নানা গ্রামে সাপ মেরে খাবার রীতি ছিল কিছু বাসিন্দার মধ্যে। তিনি ওই বাসিন্দাদের কাছ থেকে একাধিক বার মুরগির বিনিময়ে সাপ নিয়ে এসেছেন।
পেশায় গ্যারাজ মিস্ত্রি মুবারক আনসারি জানান, যখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তখন শ্রেণিকক্ষে ঢুকে যাওয়া একটি হেলে সাপ প্রথম বার ধরে জঙ্গলে ছেড়েছিলেন। তখন থেকেই সাপের প্রতি তাঁর দুর্বলতা তৈরি হয়। পরে কলকাতায় সাপ ধরার তালিম নেন দিলীপ মিত্রের কাছে। পারদর্শী হবার পরে শিল্পাঞ্চলের বেশ কয়েক জনকে সাপ ধরার তালিমও দিয়েছেন। মুবারকের ইচ্ছে, মাইথন বা পাঞ্চেতে একটি সাপ সংরক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলুক সরকার। কারণ, যথেচ্ছ বনজঙ্গল কেটে নেওয়ায় সাপেরা প্রাণ বাঁচাতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। এই আবেদন জানিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিও লিখেছেন বলে জানান। আবেদন করেছেন অন্য সরকারি আধিকারিকদেরও। এখনও সাড়া না পেলেও হতাশ হননি। ডাক পড়লেই মোটরবাইক ছোটাচ্ছেন সাপ ধরার জন্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy