Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ইয়েমেন-বিভীষিকা

বাড়ি বয়ে ওরা হাতে ধরাল একে-৪৭

রাত-দিন বোমা আর গোলাগুলির আওয়াজ। বিদেশ-বিভুঁই। প্রাণ হাতে করে চার দিন আমরা মেসের দু’টি ঘরে বন্দি। আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড় হল সোমবার। যখন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো ওরা এসে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল একে-৪৭ রাইফেল। বলল, ‘প্রয়োজনে চালাবেন।’ বলেই ফিরে চলল। আমরা তখন ভয়ে কাঁপছি। হুঁশ ফিরতেই ওদের পিছু পিছু ছুটে গিয়ে কোনও মতে বোঝালাম, ‘আমরা অস্ত্র নেব না। আমরা ও-সব চালাতে পারি না। কোনও দিন চালাইনি।’ কী ভেবে ওরা ফেরত নিল অস্ত্রগুলো।

অমল খামরুই

অমল খামরুই

অমল খামরুই
(ইয়েমেন থেকে ফিরে) শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

রাত-দিন বোমা আর গোলাগুলির আওয়াজ। বিদেশ-বিভুঁই। প্রাণ হাতে করে চার দিন আমরা মেসের দু’টি ঘরে বন্দি। আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার জোগাড় হল সোমবার। যখন মূর্তিমান বিভীষিকার মতো ওরা এসে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল একে-৪৭ রাইফেল। বলল, ‘প্রয়োজনে চালাবেন।’ বলেই ফিরে চলল।

আমরা তখন ভয়ে কাঁপছি। হুঁশ ফিরতেই ওদের পিছু পিছু ছুটে গিয়ে কোনও মতে বোঝালাম, ‘আমরা অস্ত্র নেব না। আমরা ও-সব চালাতে পারি না। কোনও দিন চালাইনি।’ কী ভেবে ওরা ফেরত নিল অস্ত্রগুলো।

বিপদ কিন্তু কাটল না। সে-রাতেই বোমা পড়ল আমাদের মেসবাড়ির গেটে। বুঝে গেলাম, আর দেরি করা যাবে না। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় পালাব? বেরিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও যে আশ্রয় নেব, সেই উপায় নেই। পদে পদে হামলার ভয়। যে-সংস্থা আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, তাদের এক জনকে ফোন করে সব জানালাম। সে-রাতটা কাটল অনাহারে। কারণ, ঘরে যে-চিঁড়েমুড়ি ছিল, চার দিনে তার সবই শেষ।

ইয়েমেনের আদেন শহরে দু’ঘরের মেসে আমরা ১৫-১৬টি প্রাণী। সকলেই পেশায় স্বর্ণকার। কেউ আছে দু’বছর, কেউ বা দেড় বছর। পূর্ব মেদিনীপুরের ডেবরা েথকে এসে মাত্র দু’মাস আগে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি আমি। প্রথমে কিছুই বুঝিনি। দশ-বারো দিন আগে যুদ্ধের উত্তাপটা গায়ে লাগে। ভেবেছিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সোমবার দুপুরে একে-৪৭ রাইফেলের ছোঁয়া আর রাতে বাড়ির সামনের বোমা সব ভরসা কেড়ে নিল। বুঝে গেলাম, বাঁচতে হলে যে-করেই হোক দেশে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যে-সংস্থা আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, রাতে ফোন করেও তাদের সাহায্য পেলাম না।

ভোর হতেই আবার ফোন করলাম ওই সংস্থার দাদাকে। তিনি জানালেন, ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। খানিকটা আশ্বাস পেলাম। কিন্তু গোলাগুলির আওয়াজ স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। বাইরে বেরোনোর সাহস পাচ্ছিলাম না। অথচ না-বেরোলে খাওয়া জুটবে না। কে বেরোবে? অনেক জল্পনার পরে এক জন দুপুরে বাইরে গেল খাবার জোগাড় করতে। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে সে যখন ফিরল, তার মুখচোখ শুকিয়ে গিয়েছে ভয়ে। কোনও রকমে ভিতরে এসে বিছানায় এলিয়ে পড়ল।

কিছু পরে ও খানিকটা ধাতস্থ হলে আমরা জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? ও বলল, অসংখ্য বাড়ি ভেঙে পড়েছে। এগোতে গেলেই লোকজন বন্দুক উঁচিয়ে তাক করছে। ওখানকার সাধারণ কিশোর-যুবক-বুড়োরাই পুলিশের মতো তল্লাশ করছে সকলকে। তবে ও বারবার নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দেওয়ায় কেউ আর কিছু বলেনি।

ও মেসে ফিরতে পারলেও আমরা কী ভাবে দেশে ফিরব, সেই চিন্তা গেল না। ঘরে খাবার নেই। নেই খাবার জলও। বিদ্যুৎ আসছে আর যাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা। আর বাড়ি ফেরা হল না ভেবে মুষড়ে পড়েছি সকলেই। এই নিরাশার মধ্যে বুধবার ভোরে আমাদের সংস্থার সেই দাদা একটি গাড়ি জোগাড় করে আসছেন বলে ফোনে জানালেন। ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম যেন! সঙ্গে সঙ্গে জামাকাপড় ব্যাগে পুরে তৈরি হয়ে গেলাম। মেসে তখন চাপা উত্তেজনা। আদৌ ফিরতে পারব তো? নাকি তীরে এসে তরী ডুবে যাবে? মরতে হবে বোমা বা গোলাগুলিতে? বারবার মনে পড়ছিল বাড়ির লোকেদের মুখ।

বেলা গড়াতেই একটি গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। বেশ বড় গাড়ি। জানলা ফাঁক করে দেখলাম, না, সেই একে-৪৭ রাইফেলওয়ালারা নয়। সংস্থার দাদাই এসেছেন। গাড়িতে উঠলাম সকলেই। ভয় কাটিয়ে আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় যাচ্ছি আমরা? দাদা আশ্বস্ত করে জানালেন, হাইকমিশন বলেছে, নৌবাহিনীর একটি জাহাজ আসছে এক কিলোমিটার দূরের বন্দরে। সেখানেই যাব আমরা। ভারতীয় নৌেসনারা এসেছেন আমাদের উদ্ধার করতে।

শুনে একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলেছি কি ফেলিনি! গাড়ির প্রায় নাকের ডগায় এসে পড়ল মর্টার। আগুন ছিটকে গেল। চালক গাড়ি সরিয়ে নিয়ে এগোতে যাবেন, ছাপছাপ জামা পরা কয়েক জন এসে গাড়ি আটকাল। আমরা কারা, খোঁজ নিতে শুরু করল দফায় দফায়। দাদা বললেন, আমরা ভারতীয়। আমরা পাসপোর্ট বার করে দেখালাম। ওরা হাতের ইশারায় আমাদের এগিয়ে যেতে বলল।

গাড়ি যত এগোচ্ছে, আমাদের ভয় বাড়ছে। দেখলাম, শেষ ১০ দিনে বোমা আর মর্টারের আঘাতে বাড়িঘর সবই প্রায় ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সেই বিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় ছোট-বড় সকলের হাতেই মেশিনগান বা একে-৪৭। সকলেই অস্ত্র উঁচিয়ে আছে। দেশে মাওবাদী দাপটের সময়ে এমন অস্ত্রধারী অনেক কম্যান্ডো দেখেছি। কিন্তু রাস্তাঘাটে ছেলে-বুড়ো সকলের হাতে এমন ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র কেমন যেন বেমানান লাগছিল।

বেড়ে যাচ্ছিল ভয়।

জাহাজ দেখে একটু আনন্দ পেলাম। ভিতরে গিয়ে চেনা লোক মনে হল সেনাদের। তাঁরাই খাবার দিলেন। ভরপেট খেলাম প্রায় সাত দিন পরে। এক দিন পরে আফ্রিকার জিবুতি বন্দরে পৌঁছলাম আমরা। সেখান থেকে আমাদের তোলা হল বিমানে। ৭-৮ ঘণ্টা পরে মুম্বই।

দেশের মাটি ছুঁয়েও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বেঁচে আছি!

ইয়েমেন থেকে ২০ জন ফিরে এলেন বাংলায়

নিজস্ব প্রতিবেদন

হাওড়ার নতুন কমপ্লেক্সের ঘড়িতে তখন রাত সওয়া আটটা। সামনে শুধু সার সার মাথা। সবার চোখ মুম্বই-হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসের বি-১ কামরার দিকে। আর হবে না-ই বা কেন? যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেন থেকে এত দিন পরে দেশে ফিরছেন স্বজনেরা। কারও বাবা, কারও ভাই, কারও বা ছেলে। সবাই রয়েছেন বি-১ কামরাতেই।

গত কালই জিবুতি থেকে বায়ুসেনার দু’টি বিশেষ বিমানে মুম্বই ও কোচিতে পৌঁছেছেন ৩৫৮ জন ভারতীয়। এঁদের মধ্যেই ছিলেন আজ হাওড়ায় ফিরে আসা পশ্চিমবঙ্গের কুড়ি জন। রুজির টানে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন। তবে সেখানে গিয়ে যে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা ঘুণাক্ষরে ভাবেননি অমল খামরুই বা শেখ সাহাবুদ্দিন— কেউই।

পশ্চিমবঙ্গের জনা কুড়ি বাসিন্দার মধ্যে বেশির ভাগই হুগলি ও পূর্ব মেদিনীপুরের। হুগলির হরিদাসপুরের সৈকর রহমানের কথায়, ‘‘দশ দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। জলও নেই। ভাল করে খেতে পাইনি। বন্ধ ঘরে শুধু বোমা আর গুলির আওয়াজ শুনেছি।’’ হুগলির হরিপালের শেখ জাহিরুদ্দিনের গলায় আতঙ্ক, ‘‘পাশের বাড়িতে শেল পড়ার শব্দ শুনে আর বাইরে যাওয়ার সাহস হয়নি।’’

স্বদেশে ফেরার জন্য ইয়েমেনে আটকে পড়া ভারতীয়রা যখন উতলা, তখনই ব্যতিক্রমী আচরণ করেছেন কয়েক হাজার কেরলীয় নার্স। নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে টাকা রোজগারের আশায় ইয়েমেন গিয়েছিলেন তাঁরা। এখনও তাঁরা ইয়েমেনেই থেকে যেতে চাইছেন। এমনই এক নার্সের কথায়, ‘‘ভারতে থাকা এবং খাওয়া এত ব্যয়বহুল! কিন্তু এখানে মাইনের কিছুটা ব্যাঙ্কেও জমাতে পারি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE