Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
ক্ষোভে ফুঁসছে নারায়ণপুর

দখল কৃষিজমি, নিশানায় ফের আরাবুল

মেঘ জমেছে নারায়ণপুরেও। ক্ষোভের মেঘ। পাওয়ার গ্রিড বিরোধিতাকে সামনে রেখে কিছুদিন আগেই আরাবুল বাহিনীর কৃষিজমি ‘দখলের’ বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ভাঙড়-২ ব্লকের পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা।

বৈরামপুরে রয়েছে শুধু খঁুটি। খুলে নেওয়া হয়েছে তার। — নিজস্ব চিত্র

বৈরামপুরে রয়েছে শুধু খঁুটি। খুলে নেওয়া হয়েছে তার। — নিজস্ব চিত্র

শুভাশিস ঘটক
ভাঙড় শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:৩৬
Share: Save:

মেঘ জমেছে নারায়ণপুরেও। ক্ষোভের মেঘ।

পাওয়ার গ্রিড বিরোধিতাকে সামনে রেখে কিছুদিন আগেই আরাবুল বাহিনীর কৃষিজমি ‘দখলের’ বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন ভাঙড়-২ ব্লকের পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। এ বার আন্দোলনে নামতে চলেছেন ভাঙড়-১ ব্লকের নারায়ণপুর পঞ্চায়েতের চারটি মৌজার জমিহারারা! তাঁরা আগে দেখে নিতে চান, কলকাতা হাইকোর্ট তাঁদের দায়ের করা মামলায় কী রায় দেয়। ওই জমিহারাদের অভিযোগ, আরাবুলরা শুধু জমিই দখল করেনি, সেখানে থাকা বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে ফেলে নিজেদের মতো করে অন্যত্র খুঁটি বসিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের গতিপথই বদলে দিয়েছে!

পোলেরহাটের আন্দোলন সামনে আসার পরেই নারায়ণপুরের জমিহারারা কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁদের অভিযোগ— অনেক আগেই পুলিশ-প্রশাসন, মুখ্যমন্ত্রীর দফতর এবং বিদ্যুৎ দফতরেও অভিযোগ জানানো হলেও সুরাহা হয়নি। মাসছয়েক আগে আলিপুর দায়রা আদালতে তাঁরা আরাবুল বাহিনীর বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ জানান। আদালত ওই জমিতে নির্মাণকাজ হবে না বলে নির্দেশ দিয়েছিল। তবু মাটি ফেলে জমি ভরাট আটকানো যায়নি। তাই গ্রামবাসীরা দিন পনেরো আগে হাইকোর্টে মামলা করেন। সেই মামলার শুনানি এখনও শুরু হয়নি।

এক জমিহারার কথায়, ‘‘হাইকোর্ট কী বলে দেখি। তার পরেই আন্দোলনে নামব। আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।’’ নানা চাপ এবং হুমকিতেও নিজের সাড়ে তিন বিঘা জমি আরাবুল বাহিনীর হাতে তুলে দেননি বৈরামপুর মৌজার এক স্কুলশিক্ষক। তাঁর ঘাড়ে নেমেছে শাস্তির খাঁড়া। তিনি বলেন, ‘‘ওরা কম দামে জমি নিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি। তাই ওরা আমার জমি ঘিরে দিয়েছে। জমিতে যাওয়ার রাস্তা নেই। আর কত দিন মুখ বুজে থাকব?’’

নারায়ণপুরে পাওয়ার গ্রিডের কোনও প্রকল্প হচ্ছে না। ঘুনিমেঘি, খড়ম্বা, বৈরামপুর ও করালবেড়িয়া—চারটি মৌজায় বাসন্তী হাইওয়ে সংলগ্ন প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে ছিল বিদ্যুতের ২৪টি খুঁটি। তাতে বিদ্যুৎবাহী তারেরও সংযোগ ছিল। আরাবুল বাহিনী এর মধ্যে ১৬০ বিঘা জমি দখল করে নেয় বলে অভিযোগ। সেই জমি আবার পাঁচিল দিয়ে ঘিরেও ফেলা হয়েছে। ওই জমিতে এখন মাত্র কয়েকটি খুঁটি অবশিষ্ট রয়েছে। নেই বিদ্যুতের তার। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, অনেক টাওয়ার উপড়ে ফেলে আরাবুল বাহিনী। তারও কেটে দেয়। তার পরে নির্দিষ্ট জমির বাইরে খুঁটি বসায়।

এ নিয়ে বিদ্যুৎ দফতরে অভিযোগ জানিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের অভিযোগ, কেউ কর্ণপাতও করেননি। তথ্য জানার অধিকার আইনে (আরটিআই) জানতে চাওয়া হলেও বিদ্যুৎ দফতরের তরফে কোনও জবাব মেলেনি। বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানান, ওই এলাকায় কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখেই বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হবে।

কীসের জন্য আরাবুল বাহিনীর বিরুদ্ধে এত কৃষিজমি দখলের অভিযোগ? পোলেরহাটের ক্ষেত্রে যা ছিল, এ ক্ষেত্রেও তাই। প্রোমোটার সংস্থাকে জমি বিক্রি।

পোলেরহাটে পাওয়ার গ্রিডের জন্য জমি নেওয়া শুরু হয়েছিল বছর চারেক আগে। নারায়ণপুরে বিদ্যুতের খুঁটি বসেছিল তারও আগে। ২০০৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে ভাঙড়ের বিধায়ক হন আরাবুল ইসলাম। তার পরেই তাঁর নির্দেশে চারটি মৌজায় ‘মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের আবাসন প্রকল্প’ হবে বলে প্রচার শুরু করে তাঁর দলবল— দাবি গ্রামবাসীদের। এর পরেই জমি ‘দখল’ শুরু। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, আরাবুলের জামাইয়ের সংস্থা চাষিদের জমি নিয়ে প্রোমোটার সংস্থাকে বিক্রির বরাত নেয়। কিন্তু বিদ্যুতের খুঁটি থাকায় জমির তেমন দাম মিলবে না বলেই তা উপড়ে ফেলা হয়। কম দামে ভয় দেখিয়ে জমি নেওয়া হয়। যাঁরা জমি দিতে রাজি হননি, তাঁদের উপরে নানা ভাবে ‘অত্যাচার’ চলে থাকে।

এক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘জমি দিতে রাজি না হওয়ায় চাষ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফসল নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’’ আর এক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘ওরা খাসজমিও দখল করেছে। পাট্টা পাওয়া ১২ জন চাষিকে মারধর করে গ্রামছাড়া করেছে। ওদের থামানোর কেউ নেই।’’

পোলেরহাটের আন্দোলনকে এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি প্রশাসন বা শাসক দল। সেখানে এখনও আরাবুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। তার মধ্যেই নারায়ণপুরের ক্ষোভও প্রকাশ্যে এল। কী হবে?

জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, চাষিদের অভিযোগের ভিত্তিতে বছর খানেক আগে আরাবুল বাহিনীর এক জনকে থানায় ডেকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওঁর দলের নেতাদের চাপ থাকায় তাঁকে বেশিক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। গত বছর ভোটে জিতে ভাঙড়ের বিধায়ক হন রেজ্জাক মোল্লা। তিনি কী করেছেন? বিধায়কের জবাব মেলেনি। তবে, তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, চাষিদের অভিযোগ জানার পরে বিধায়ক বৈঠক করেছিলেন। সেখানে আরাবুলও ছিলেন। কিন্তু আরাবুল কোনও কথা মানতে চাননি। বিধায়ক সব কথা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছিলেন।

পোলেরহাটের মতো নারায়ণপুরেও জমি দখলের কথা মানেননি আরাবুল। তাঁর দাবি, ‘‘ওখানে চাষিদের সঙ্গে প্রোমোটারদের নানা সমস্যা রয়েছে। বারদুয়েক ডাকা হয়েছিল বলে আমি গিয়েছিলাম। গোলমালে আমি জড়িত নেই।’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য ফের জানিয়েছেন, নানা দিক থেকে নানা অভিযোগ আসছে। সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দল পদক্ষেপ করবে।

দিন গুনছে নারায়ণপুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

forceful possession Arabul Islam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE