Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভুঁইফোঁড় আর্সেনিকে জর্জরিত নদীর স্রোতও

ভূগর্ভ ছাড়িয়ে ভূস্তরে। মাটির নীচে তো থাবা বসিয়েছে বহু আগেই। এ বার নদীর জলেও প্রবল পরাক্রমে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করেছে মারণ আর্সেনিক। পাতাল নিংড়ে অত্যধিক জল তুলে নেওয়ায় নলকূপের জলের সঙ্গে আর্সেনিক উঠে আসাটা অনেক জায়গায় প্রায় গা সওয়া হয়ে গিয়েছে।

প্রভাত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

ভূগর্ভ ছাড়িয়ে ভূস্তরে। মাটির নীচে তো থাবা বসিয়েছে বহু আগেই। এ বার নদীর জলেও প্রবল পরাক্রমে নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে শুরু করেছে মারণ আর্সেনিক।

পাতাল নিংড়ে অত্যধিক জল তুলে নেওয়ায় নলকূপের জলের সঙ্গে আর্সেনিক উঠে আসাটা অনেক জায়গায় প্রায় গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় সেখানে তৃষ্ণা মেটানোর একমাত্র ভরসা ছিল নদীর বহমান স্রোত। কিন্তু সেই ভরসাতেও জল ঢেলেছে আগ্রাসী আর্সেনিক। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল, ডোবার মতো জলের আপাত ‘নিরাপদ’ উৎসও এখন আর্সেনিকের বিষে জর্জরিত!

বস্তুত বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষের সেচ-নালায় আর্সেনিকের ভাল রকম উপস্থিতি ধরা পড়েছে। বিশেষত নদিয়া জেলার ছবিটা ঘোর উদ্বেগজনক। ওড়িশা-ছত্তীসগঢ়েও নদীর জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক মিলেছে।

অবাধে নদীর জল তোলার বিপদ কতটা, এখানে সেটাও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। যেমন ছত্তীসগঢ় সরকার খাগড়াহনি নদীর প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় অবাধে জল তোলার লাইসেন্স দিয়েছে এক বেসরকারি সংস্থাকে। ওই রাজ্যেই কেলো নদীর তীরবর্তী ২২ কিলোমিটার এলাকায় জল তোলার অনুমতি পেয়েছে আর এক বেসরকারি কোম্পানি। এবং জল-মান যাচাইয়ের কেন্দ্রীয় সংস্থা ‘ওয়াটার কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট অথরিটি’র রিপোর্ট, দু’টি জায়গাতেই নদীর জল আর্সেনিকে বিষিয়ে গিয়েছে। বিশ্বভারতীর নদী-বিশেষজ্ঞ মলয় মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, “ভূগর্ভের জল নির্বিচারে তোলার সর্বনাশা পরিণাম কলকাতা-সহ রাজ্যের আট-ন’টি জেলায়টার পাওয়া যাচ্ছে। এখন যে ভাবে নদীর জল লুঠ হচ্ছে, তাতেও ঘোর বিপদ।”

কেন্দ্রীয় জলসম্পদ মন্ত্রকের রিপোর্টেও অশনি সঙ্কেত। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সমীক্ষা উদ্ধৃত করে মন্ত্রকের রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশের অন্তত ১২০টি নদীর জলে আর্সেনিক, তামা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সিসা, পারদ, নিকেলের মতো বিষাক্ত ধাতু মজুত। এগুলোর মধ্যে মূলত আর্সেনিকের মাত্রা সহনসীমার বহু গুণ বেশি। নদীর জলে অন্যান্য ধাতুর বিষাক্ত প্রভাব দূর করার লক্ষ্যে নয়াদিল্লি জাতীয় নদী সংরক্ষণ প্রকল্প (এনআরসিপি) তৈরি করলেও আর্সেনিক হঠানোর কোনও পরিকল্পনা এখনও হয়নি বলে কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর। নদী কী ভাবে আর্সেনিকের শিকার?

নদী-বিশেষজ্ঞ তথা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের ব্যাখ্যা, “নদীর জলের দু’ধরনের চরিত্র। বর্ষায় বৃষ্টির জল বুকে নিয়ে নদী বেঁচে থাকে। শুখা মরসুমে পাশের ভূস্তরের ভিতরে জমা জল চুঁইয়ে এসে নদীতে মেশে। কিন্তু ভূগর্ভ থেকে অত্যধিক জল উঠে আসায় সেখানে জমা আর্সেনিক জলের সঙ্গে উঠে নানা ভাবে নদীতে এসে মিশছে।”

উপরন্তু ভূগর্ভের পলিমাটি- আস্তরণে এমনিতেই প্রচুর আর্সেনিক। দুইয়ে মিলে নদীকে গ্রাস করছে। ভূগর্ভে এত আর্সেনিক এল কোথা থেকে? উত্তর খুঁজেছেন আমেরিকার চার ভূতত্ত্ববিদ স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কট ফেনডর্ফ, ক্রিস ফ্রান্সিস, ম্যাট পোলিজোট্টো এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারেন সেটো। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, মায়ানমার, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে দশ বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে ওঁরা জানিয়েছেন, হিমালয়ের আর্সেনিকে ভরপুর নানা আকারের পাথরখণ্ড (আর্সেনোপাইরাইট) স্রোতের টানে নেমে আসে হিমালয় থেকে উৎপন্ন চারটি প্রধান নদীতে ভারতের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র, মায়ানমারের ইরাবতী, চিনের হোয়াংহো ও কম্বোডিয়ার মেকঙে। বিপর্যয়ের সূত্রপাত এখানেই। পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের অন্যতম সদস্য, ভূতত্ত্ববিদ এস পি সিংহরায়ের কথায়, “ব্যাপারটা চলছে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে। হিমবাহের সঙ্গে সমতলে নেমে আসছে আর্সেনোপাইরাইট। সঞ্চিত হচ্ছে আর্সেনিকের ভাণ্ডার।” তাঁর অবশ্য দাবি, পরিস্থিতি এখনও একেবারে হাতের বাইরে চলে যায়নি।

কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা বিশেষ নেই। আর এ প্রসঙ্গে আঙুল উঠছে প্রশাসনের দিকেও। অভিযোগ, পর্যাপ্ত শিল্প-পরিকাঠামো না-থাকারই মাসুল তুলছে আর্সেনিক। পরিকল্পিত সরবরাহের অভাবে বিভিন্ন নদী থেকে কারখানার জন্য যথেচ্ছ ভাবে জল ওঠানো হচ্ছে। এমনকী, প্রবল গ্রীষ্মেও কংসাবতী-দামোদরের বুক খুঁড়ে জল তোলায় ভাটা পড়ছে না। নদী ভরে উঠছে আর্সেনিকের বিষে।

পাশাপাশি পুকুর বা ডোবায় আর্সেনিক দূষণের জন্যও ভূগর্ভের জলস্তরে নিরন্তর আঘাতকে দায়ী করছেন ভূতত্ত্ববিদেরা। ওঁদের বক্তব্য: অগভীর নলকূপের সাহায্যে মাটির নীচের জল তুলে শুকনো পুকুরে হামেশা ফেলা হয়। তারই সঙ্গে আর্সেনিক উঠে আসে। রাজ্যে আর্সেনিক-আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত জেলাগুলির বাইরেও অনেক জায়গায় বিস্তর জলাশয় এই ভাবে ক্রমে দূষিত হয়ে পড়ছে।

রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী?

ভূগর্ভের আর্সেনিককে ঠেকাতে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর তিন বছর আগে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পানীয় জলের নতুন যাবতীয় প্রকল্প হবে ভূস্তরের জলের উপরে নির্ভর করে। আর্সেনিক দূরীকরণের যৌথ প্রকল্প গড়তে সুইডিশ সংস্থার সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু ভূস্তরের জলেও ইদানীং যে হারে আর্সেনিকের আগ্রাসন, তাতে উদ্দেশ্য কতটা সিদ্ধ হবে, সেই প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE