Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

‘ক্রীতদাস’ ছেলেকে ছাড়াতে হন্যে বাবা

মুঠোয় ফোনটা নিয়ে রাতে শুতে যান নৈহাটির মামুদপুরের বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস। কিন্তু ঘুম কি আর আসে? ২৪ ঘণ্টাই মোবাইলটা নিয়ে বসে থাকেন কেউ না কেউ। যদি এক বার ফোন করে বাড়ির ছোট ছেলে জয়ন্ত। সেই সৌদি আরব থেকে।

জয়ন্ত বিশ্বাস

জয়ন্ত বিশ্বাস

বিতান ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩০
Share: Save:

মুঠোয় ফোনটা নিয়ে রাতে শুতে যান নৈহাটির মামুদপুরের বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস। কিন্তু ঘুম কি আর আসে? ২৪ ঘণ্টাই মোবাইলটা নিয়ে বসে থাকেন কেউ না কেউ। যদি এক বার ফোন করে বাড়ির ছোট ছেলে জয়ন্ত। সেই সৌদি আরব থেকে।

মাস কয়েক আগে অনেক রাতে এক দিন ফোন করেছিলেন জয়ন্ত। কথা বলার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথবাবু ও তাঁর স্ত্রী বেবিদেবী। ফিসফিস করে জয়ন্ত বলেছিলেন, ‘‘আমাদের এরা গাড়ি কোম্পানিতে কাজ দেওয়ার নাম করে বাড়িতে ক্রীতদাস বানিয়ে রেখেছে। যে চাকরির টোপ দিয়েছিল, সব মিথ্যে। খেতেও দেয় না। খুব অত্যাচার করে।’’

জয়ন্ত এক জন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। সৌদি আরবে গিয়েছিলেন গাড়ি কোম্পানির চাকরি করতে। আর সে দেশে পৌঁছে বুঝেছিলেন, তাঁকে বেচে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি কোম্পানির মালিক নঈফ বুকমি তাঁকে কিনেছে ব্যক্তিগত ক্রীতদাস হিসেবে। যে দাসের কাজ— ২৪ ঘণ্টা বাড়ির খিদমত খাটা, ঘাস কাটা, সেই ঘাস বিক্রি করা, ছাগল চরানো, উটের পরিচর্যা। কোনও মাইনে নেই। একবেলা আধপেটা খাওয়া। উট যে গামলায় জল খায়, জল খেতে হবে সেখান থেকেই। বেচাল দেখতেই অত্যাচার।

মাস কয়েক আগে বাবার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি। সম্প্রতি দিদিকে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকটা অডিও ফাইল পাঠান জয়ন্ত। তাতে ফিসফিসে গলায় নিজের দুর্দশার কথাগুলো আর একটু খোলসা করে বলেছেন। আজও দেশে ফিরতে পারেননি জয়ন্ত। অডিও ফাইলে তিনি জানিয়েছেন, রিয়াধের ভারতীয় দূতাবাসের অফিসারদের প্রায় হাতেপায়ে ধরেছেন তিনি। কিন্তু তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘আমরা আর কিছু করতে পারব না। মালিকের কাছে ফিরে যাও। তিনিই তোমায় দেশে পাঠাবেন।’’ বাবা চিঠি লিখেছেন বিদেশ মন্ত্রকে। কাকা রঞ্জিতবাবু দিল্লিতেই পড়ে রয়েছেন। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ টুইটারে অভিযোগ পেয়ে বহু মানুষকে প্রায়শই সাহায্য করেন। এই ঘটনাটিও তাঁকে টুইট করে জানিয়েছে জয়ন্তর পরিবার। বাবা চিঠিও লিখেছেন বিদেশমন্ত্রীকে। তবে সুষমা এখনও অবধি চুপচাপ। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ সংবাদমাধ্যমের কাছে সব শুনেও কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

গোটা ঘটনায় রিয়াধের ভারতীয় দূতাবাসের গড়িমসিই স্পষ্ট বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কেন এই নির্লিপ্তি, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। পরিবারের বক্তব্য, দূতাবাসের এক অফিসার নাকি বলেছেন, নিয়মের গেরোয় আটকে রয়েছে জয়ন্তর ফেরা। দেশে ফিরতে হলে সৌদি আরবে জয়ন্তর সংস্থার প্রধান এবং ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) চাই। কিন্তু পরিবারের আশঙ্কা, জয়ন্তর ‘বস’ তো আসলে সেই অত্যাচারী মালিক। খাতায়-কলমে সে হয়তো দেখাবে যে, জয়ন্ত তার গাড়ি কোম্পানিরই কর্মী।

মামুদপুরের সুভাষপল্লিতে জয়ন্তদের বাড়ি। এক চিলতে ঘর। জমি যতটুকু ছিল, প্রথমে জয়ন্তর পড়াশোনা তার পর বিদেশ পাঠানোর খরচ জোগাতে গিয়ে তার প্রায় সবটাই বিক্রি করে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথবাবু। ২০১৫-য় কোচবিহার থেকে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এ বছরের গোড়ার দিকে পুণের একটি গাড়ির ওয়ার্কশপে কিছু দিন চাকরি করেন জয়ন্ত। সেখানেই অনলাইনে যোগাযোগ হয় সৌদি আরবের একটি সংস্থার সঙ্গে। দিল্লি ও মুম্বইয়ের তিন এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে জয়ন্ত যাতায়াত খরচ ছাড়াও এক লক্ষ টাকা দেন মুনির আহমেদ নামে এক এজেন্টকে। ওই এজেন্টই ‘আল হামিদ ম্যান পাওয়ার কনসালট্যান্ট’ নামে একটি সংস্থা চালান দিল্লিতে। মূলত সৌদি আরবে বিভিন্ন কাজে লোক পাঠানোর বরাত নেন তাঁরা।

ওই এজেন্টের মাধ্যমেই এইচ এম সাদিক ও তবরেজ আলম নামে আরও দুই এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ হয় জয়ন্তর। পর্যটন ভিসা নিয়ে ১৫ মে রিয়াধে পৌঁছন জয়ন্ত। এজেন্টরা জানিয়েছিল, তিন মাস পরে ওয়ার্ক ভিসা পাবেন তিনি। বেতন ভারতীয় টাকায় তিরিশ হাজার টাকা।

তার পর? ভয়েস ক্লিপে জয়ন্ত জানিয়েছেন, মরুভূমির মধ্যে নইফের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। শুরু হয় নরকযন্ত্রণা। মাস দুয়েক পরেই সেখান থেকে পালান। পৌঁছন ভারতীয় দূতাবাসে। জয়ন্তর কথায়, ‘‘দূতাবাসে যোগাযোগ করতে ওঁরা বলেছিলেন, আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। অথচ অভিযোগ লিখিয়েই ওঁরা আমাকে তাড়িয়ে দেন। শেষে এক জায়গায় সব্জি বিক্রির কাজ নিই। দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। এক দিন এক সমাজসেবীর নম্বর দিল (কে নম্বর দিয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপ ক্লিপে তা স্পষ্ট নয়)। তিনি আমায় রেখে এলেন দামাম বলে একটা শহরের ডিপোর্টেশন সেন্টারে। দেখলাম, আমার নামে চুরির মামলা হয়েছে।’’

দামামে এক মাস, রিয়াধে দু’মাস জেল খাটার পর অক্টোবরে মালিকই জয়ন্তকে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়েই ফের শুরু হয় বেগার খাটা। জয়ন্ত বলেছেন, ‘‘এই সময়ে এজেন্টের এক ভাই আমাকে বলে-কয়ে ওর ওখানে নিয়ে আসে। সেখানেই এখন রয়েছি। মালিক বারবার বলছে, ‘আমার কাছে চলে এসো। আমি দেশে ফেরত পাঠাব।’ কিন্তু সত্যিই পাঠাবে কি না, তার কোনও গ্যারান্টি নেই।’’

‘ওর ওখানে’ বলতে কী বোঝাচ্ছেন জয়ন্ত? পারিবারিক সূত্রের বক্তব্য, হাফিজুল রহমান নামে ভারতীয় দূতাবাসের এক অফিসারের সঙ্গে জয়ন্তর কথা হয়েছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। এখন সম্ভবত জয়ন্তর কোনও এক এজেন্টের ভাই তাঁকে কোথাও আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু ভয়েস ক্লিপে জয়ন্ত জানিয়ে দিয়েছেন, সেখানে একেবারেই নিরাপদ বোধ করছেন না তিনি। ভয় পাচ্ছেন, মালিক হয়তো ফের তুলে নিয়ে যাবে। আসলে জয়ন্ত নিজে ফোন না করলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কোনও রাস্তাই নেই পরিবারের কাছে।

অসহায় রবীন্দ্রনাথবাবু স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কী ভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা যায়, তা জানতে। জয়ন্তর মা বলছেন, ‘‘ওরা আরও টাকা চাইছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সব পারেন। এক বার শুধু আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিন। আমি ছেলেকে ভিক্ষে চাইব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Slavery Automobile engineer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE