Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
সারদা কেলেঙ্কারি

মন্ত্রিত্ব ছেড়েও লাভ হল না, জেলেই যেতে হল মদন মিত্রকে

রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রীর পদে তাঁর ইস্তফা গৃহীত হয়েছে বুধবার রাতে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবারের বারবেলায় মদন মিত্রের জামিন খারিজ করে দিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের নির্দেশে ১৯ দিনের গৃহবন্দি-জীবনকে পিছনে ফেলে আলিপুর জেলেই রাত কাটাতে হল সদ্য-প্রাক্তন মন্ত্রীকে।

আলিপুর আদালতে যাওয়ার পথে, বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

আলিপুর আদালতে যাওয়ার পথে, বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রীর পদে তাঁর ইস্তফা গৃহীত হয়েছে বুধবার রাতে। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বৃহস্পতিবারের বারবেলায় মদন মিত্রের জামিন খারিজ করে দিল কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালতের নির্দেশে ১৯ দিনের গৃহবন্দি-জীবনকে পিছনে ফেলে আলিপুর জেলেই রাত কাটাতে হল সদ্য-প্রাক্তন মন্ত্রীকে।

এ দিন দুপুরেই মদনের জামিন বাতিলের নির্দেশ দেয় হাইকোর্টের বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি তাপস মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। রাত ১১টার কিছু পরে রায়ের কপি পৌঁছয় আলিপুর আদালতে। সেখান থেকে আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ টিভিতে শোনার পর আত্মসমর্পণ করতে বিকেলেই মদন পৌঁছে যান আলিপুর আদালতে। তার আগে ভবানীপুরের বাড়ি থেকে বেরনোর মুখে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘হাইকোর্টের নির্দেশের কপি এখনও পাইনি। টিভিতে শুনলাম আমাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। আমার আইনজীবীও তাই জানিয়েছেন। আদালতের নির্দেশকে সম্মান জানিয়ে লিখিত নির্দেশের অপেক্ষা না করেই আমি আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি। কারণ, আদালতের কোনও নির্দেশ আমি অমান্য করব না।’’ আলিপুর আদালতের বিচারক অবশ্য জানান, হাইকোর্টের লিখিত নির্দেশ না আসা পর্যন্ত মদনবাবুকে অপেক্ষা করতে হবে। হাইকোর্ট থেকে রায়ের প্রতিলিপি আসতে অনেক রাত হয়ে যায়। ফলে আদালতের বার লাইব্রেরিতে দীর্ঘ সময় কাটাতে হয় মদনবাবুকে। আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারক সৌগত রায়চৌধুরীর এজলাসে মদনবাবুকে হাজির করানো হলে বিচারক ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। রাত বারোটা নাগাদ জেলে ঢোকেন তিনি।

পড়ুন: খাঁচায় ফিরল টাইগার, তৃণমূল নিস্পৃহই

সারদা-কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত মদনকে ৩১ অক্টোবর শর্তাধীন জামিন দেয় আলিপুর আদালত। সেই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যায় সিবিআই। ৫ নভেম্বর মামলার শুনানিতে হাইকোর্টের অবকাশকালীন ডিভিশন বেঞ্চ মদনকে কার্যত গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দেয়। সে দিনই তারা জানায়, পরবর্তী শুনানি হবে ১৭ নভেম্বর। কিন্তু ওই দিন মদনের আইনজীবী আদালতে হলফনামা পেশ করতে না পারায় শুনানির দিন ধার্য হয় বুধবার। বুধবার শুনানির পরে এ দিন ফের সকাল থেকে ডিভিশন বেঞ্চে মদনের পক্ষে সুরেন্দ্র কপূর ও সিবিআইয়ের তরফে কে রাঘবচারিলু সওয়াল শুরু করেন। তাঁদের সওয়াল শেষে কিছু ক্ষণ বিরতির পর দুপুর ২টো ২০ মিনিটে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ভরা আদালত কক্ষে জানান, মদন মিত্রের জামিন বাতিল নিয়ে সিবিআইয়ের আবেদন মঞ্জুর করা হল। জানিয়ে দেন, অবিলম্বে মদনবাবুকে আলিপুর আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আইনজীবী কপূর আত্মসমর্পণের জন্য সাত দিন সময় চাইলেও তা খারিজ করে বিচারপতি জানান, অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করতে হবে তাঁকে।

আইনজীবীদের একাংশের মতে, মদনের জামিন যে খারিজ হতে পারে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল বুধবারই। তাঁদের দাবি, শুনানি চলাকালীন মদনের আইনজীবীর বিভিন্ন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতিরা যে সব মন্তব্য করেন, তাতেই জামিন খারিজের ইঙ্গিত ছিল। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল মন্ত্রিত্ব। মন্ত্রী থাকতে চান না বলেই গত বছর গ্রেফতার হওয়ার আগেই পদত্যাগপত্র পাঠান মদন। অভিযোগ, এত দিন ধরে তা পড়েই ছিল নবান্নে। বুধবার বিচারপতিদের কটাক্ষ শুনে রাতেই তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। সিলমোহর দেন রাজ্যপালও। এ দিন শুনানি চলাকালীন মন্ত্রিত্বের বিষয়টি আর সামনে আনেননি দু’পক্ষের আইনজীবীরা। মনে করা হচ্ছে, ফের বিচারপতিদের তির্যক মন্তব্যের সামনে পড়তে পারেন, এই ধারণা থেকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করেননি মদনের আইনজীবী সুরেন্দ্র কপূর। তিনি যখন সওয়াল করার সময় পিছন থেকে মদনের বড় ছেলে স্বরূপ এক জুনিয়র আইনজীবীকে ডেকে বিষয়টি উত্থাপন করার কথা বলেন। কিন্তু সেই আইনজীবী ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দেন, তাঁরা বিষয়টি আদালতে তুলতেই চান না। মদনের মন্ত্রিত্ব নিয়ে বুধবার পর্যন্ত সরব থাকলেও এ দিন সিবিআই-কৌঁসুলি রাঘবচারিলুও এই নিয়ে একটি কথা বলেননি। এ দিন সকালে কপূর আদালতে বলেন, ‘‘মদন মিত্র যদি পালিয়ে বেড়াতেন, তা হলেও না হয় তাঁর জামিন বাতিল হতে পারত। তিনি অসুস্থ। বাড়িতে শয্যাশায়ী। তিনি কী করে তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করবেন?’’ এ প্রসঙ্গে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ মামলার উদাহরণও এ দিন আদালতে উল্লেখ করেন কপূর। আরও বলেন, ‘‘৩১ অক্টোবর নিম্ন আদালতের বিচারক যখন জামিন দেন, তখন ইচ্ছাকৃত ভাবে সিবিআই-কৌঁসুলি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ফলে বিচারক সঙ্গত মনে করেছিলে‌ন বলেই জামিন দিয়েছিলেন।’’

পড়ুন: টেনশন কাটাতে মদনের মুখে দিনভর সাদা পান

রাঘবচারিলু বলেন, ‘‘যে পদ্ধতিতে জামিন দেওয়া হয়েছে, তারই বিরোধিতা করে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’’ নিম্ন আদালতের রায়ের অংশও উল্লেখ করেন রাঘবচারিলু। মদনকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দেওয়ার দিনেও অবকাশকালীন ডিভিশন বেঞ্চের বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী প্রশ্ন তোলেন, ৬ অগস্ট হাইকোর্ট জামিনের আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পরেও কী এমন হল যে নিম্ন আদালত জামিন দিল? বুধবার একই প্রশ্ন তুলে মদনের আইনজীবীর কাছে উত্তর চান বিচারপতি মাত্রে। সিবিআই-কৌঁসুলি বলেন, ‘‘সে দিনের সেই রায় বিকৃত, বেঠিক ও খামখেয়ালি। তা বাতিলেরই দাবি জানাচ্ছি।’’ এ দিনও তিনি উল্লেখ করেন মদনের প্রাক্তন গাড়িচালক শম্ভু সাউ-এর কথা। যিনি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দিয়ে জানিয়েছেন, সিবিআইয়ের সামনে মুখ খোলার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে মদন মিত্রের ছেলে লোকজন নিয়ে তাঁকে হুমকি দিয়ে এসেছিলেন।

সিবিআইয়ের এই মামলার তদন্তকারী অফিসার ফণিভূষণ কর্ণ। বুধবার কৌঁসুলি কপূর একবার তাঁর নাম উল্লেখ করার সময়ে বলেছিলেন, ‘‘ওই যে কর্ণ, না কুম্ভকর্ণ, না রাবণ কে একজন অফিসার আছেন!’’ এ দিন তার প্রেক্ষিতে রাঘবচারিলু বলেন, ‘‘একজন অতিরিক্ত এসপি পদের অফিসার, যিনি বাড়ি-ঘর ছেড়ে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেয়ে, দিন-রাত না ঘুমিয়ে তদন্তের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁর সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য থেকেই পরিষ্কার, কী ধরনের মানুষ এঁরা!’’ রাঘবচারিলু মনে করিয়ে দেন, এই মামলা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা অপরাধ নয়। গোটা সমাজের বিরুদ্ধে করা অপরাধ।

আলিপুরের অবকাশকালীন বিচারকের নির্দেশ নিয়েই প্রশ্ন তুলে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে বলেন, ‘‘যে কোনও দিক দিয়ে বিচার করলেই দেখা যাচ্ছে অবকাশকালীন বিচারকের (নিম্ন আদালতের) নির্দেশ ন্যায়ভ্রষ্ট। বিচার ব্যবস্থার যে ভিত্তি রয়েছে, ওই নির্দেশ তার পরিপন্থী।’’ তার পরেই তিনি সিবিআইয়ের আর্জি মেনে মদন মিত্রের জামিন খারিজের নির্দেশ দেন।

কোর্ট তাঁর আবেদন মেনে নেওয়ার পরে রাঘবচারিলু সাংবাদিকদের সামনে হাতজোড় করে বলেন, ‘‘ন্যায়ের এই মন্দিরের প্রতি আমার প্রণাম।’’ জয়ের খুশিতে এক সময় তাঁর চোখেও জল চিকচিক করছিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE