বার্নপুরের বাড়িতে স্বামীর ছবির সামনে শেফালিদেবী। ছবিটি তুলেছেন শৈলেন সরকার।
দিনের আলো ফুটেছে সদ্য। সাড়ে ৬টা-পৌনে ৭টা। ফাঁকা রাস্তা ধরে আস্তেই আসছিল মোটরবাইকটা। চালক এক যুবক। পিছনে সালোয়ার-কামিজ পরা মহিলা। যুবকের মাথায় হেলমেট, মহিলার মুখ ঢাকা কাপড়ে।
রাষ্ট্র হিন্দ ক্লাবের মাঠে প্রাতর্ভ্রমণ সেরে রাস্তার দিকে যাচ্ছিলেন বারাবনির প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক দিলীপ সরকার। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে দেখে গতি আরও কমে মোটরবাইকের। পিছনে বসা মহিলা চকিতে ৯ এমএম পিস্তল বার করে গুলি চালায় পরপর। দু’টি গুলি লাগে দিলীপবাবুর পেটে। সেই অবস্থাতেই দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। ধাওয়া করে এসে ফের কয়েকটি গুলি চালায় ওই মহিলা। পিঠে আরও দু’টি গুলি লেগে মুখ থুবড়ে পড়লেন বছর আটষট্টির দিলীপবাবু।
ঘটনাস্থল বার্নপুরের আপার রোড। ২০১৩ সালের ৯ জুন সেখানেই মৃত্যু হয় দিলীপবাবুর। তিনি তখন দলের বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। খুনের পরে নিমেষে এলাকা ছেড়েছিল মোটরবাইক আরোহীরা। আজ অবধি তাদের হদিস পায়নি পুলিশ। অপরাধীদের ধরার দাবিতে বন্ধ, মিছিল, ঘেরাও-বিক্ষোভ, সভা— অনেক কিছুই হয়েছিল। কিন্তু প্রায় তিন বছর কেটে গেলেও গ্রেফতার তো দূর, কাউকে আটক পর্যন্ত করতে পারেনি পুলিশ।
২০১৩ সালের ৯ জুন সকালে বার্নপুরের আপার রোডে খুন।
মোটরবাইকে চেপে আসে দু’জন।
গুলি চালায় মুখ ঢাকা মহিলা আততায়ী।
প্রায় তিন বছরেও কেউ ধরা পড়েনি।
বার্নপুরের পুরানহাটের বাড়ির সদর দরজায় ঝোলানো বোর্ডে এখনও জ্বলজ্বল করছে দিলীপবাবুর নাম। কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন তাঁর স্ত্রী শেফালি সরকার। নিঃসন্তান বিধবার ক্ষোভ, স্বামীর মৃত্যুর পরে এত দিন কেটে গেলেও কারা, কী মতলবে তাঁর স্বামীকে খুন করে গেলে— তা জানাতে পারেনি পুলিশ। শেফালিদেবী জানালেন, প্রায় তিন বছরেও খুনের কিনারা না হওয়ায় তিনি প্রশাসন ও সরকারের উপরে আস্থা হারিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৪ সালের মার্চে রাজ্যপালের সঙ্গেও দেখা করে ন্যায়-বিচার চেয়ে আবেদন জানিয়েছি। ঘটনার পরে অনেক বারই বাড়িতে পুলিশ এসেছে। অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছে। কিন্তু বুঝতে পারছি, তদন্ত কিছুই এগোয়নি।’’ তাঁর দাবি, পুলিশ জানিয়েছে, খুনের জন্য ঝাড়খণ্ড থেকে ভাড়াটে খুনি আনা হয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা তাদের কাজে লাগাল, সে ব্যাপারে কোনও দিশা পুলিশ দিতে পারেনি।
পুলিশের অবশ্য দাবি, মৃতের পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে বহু বার কথা বলা হলেও কোনও দিশা মিলছে না। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের এডিসিপি (পশ্চিম) বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। কিন্তু দুষ্কৃতীরা অধরাই।’’ কেন আততায়ীরা অধরা, তার কোনও ব্যাখ্যা দেননি ওই পুলিশ-কর্তা।
তবে কমিশনারেটের এক কর্তা জানান, প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল, ঘটনার পিছনে ওই নেতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কেউ জড়িত রয়েছেন। তাই বেছেবেছে দিলীপবাবুর ছায়াসঙ্গীদেরই একাধিক বার জেরা করা হয়েছে। কিন্তু, এমন কোনও তথ্য মেলেনি যা থেকে নির্দিষ্ট কোনও সূত্র মেলে। দিলীপবাবুর এক সময়ের ছায়াসঙ্গী চন্দন মিশ্র আবার অভিযোগ করেন, পুলিশ শুধু দিলীপ-ঘনিষ্ঠদেরই বারবার জেরা করেছে। আর কিছুই করেনি। অন্য দিক খতিয়ে দেখলে হয়তো কোনও সূত্র মিলতে পারত।
শেফালিদেবী অবশ্য এখনও নিশ্চিত, খুনের পিছনে যে বা যারা রয়েছে, তারা তাঁর স্বামীর গতিবিধির সঙ্গে পরিচিত। কারণ, দিলীপবাবু প্রতিদিনই প্রাতর্ভ্রমণে যেতেন। কিন্তু একই সময়ে বা একই জায়গায় যেতেন না। আততায়ীদের কাছে সে তথ্য ছিল বলে তারা রাস্তা থেকে তাঁকে অনুসরণ করেছিল। শেফালিদেবীর খেদ, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ঘটনার কথা ভুলতে বসেছেন সকলেই। এমনকী, দিলীপবাবুর দলের পুরনো কর্মীরাও এখন আর যোগাযোগ রাখেন না বলে তাঁর দাবি।
যদিও সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য বংশগোপাল চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা শেফালিদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। দল গোটা বিষয়টি অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গেই দেখছে। ঘটনার কিনারা চেয়ে একাধিক বার পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। অবস্থান-বিক্ষোভও করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের উপরে আর ভরসা রাখতে পারছি না।’’এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরের মার্চেই শহর ছেড়ে কলকাতায় ভাইয়ের বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন শেফালীদেবী। বিধবার আক্ষেপ: ‘‘অন্ধকারেই রয়ে গেলাম!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy