Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Gaurav Gogoi

বামে, না তৃণমূলে? বিভক্ত কংগ্রেস, রাহুলের বৈঠকের আগেই রিপোর্ট দিচ্ছেন গগৈ

তিন দিনের বাংলা সফরে গৌরব গগৈ। এআইসিসি পর্যবেক্ষক গৌরব গগৈ ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কাটিয়ে গেলেন।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৮ ২১:১১
Share: Save:

ভাঙতে ভাঙতে বেহাল দল। একের পর এক বিধায়ক নাম লেখাচ্ছেন তৃণমূলে। আর সমর্থকদের একাংশ ঝুঁকছেন বিজেপির দিকে। যে বিধায়করা দল ছাড়ছেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই দোষ দিচ্ছেন প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীকে। দলে থেকেও একাংশ সরব হচ্ছেন অধীরের কট্টর তৃণমূল বিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে। কিন্তু অধীর শিবিরও অবিচল নিজেদের লাইনে। এমন পরিস্থিতিতেই বাংলার কংগ্রেস নেতাদের ডেকে পাঠিয়েছেন রাহুল গাঁধী। তার আগে তিন দিন বাংলা ঘুরে রিপোর্ট তৈরি করলেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক গৌরব গগৈ। অধীরদের সঙ্গে রাহুলের বৈঠকের আগেই ২৪ আকবর রোডে পৌঁছে যাচ্ছে তাঁর রিপোর্ট।

বাংলার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে রাহুল গাঁধীর বৈঠক ৬ জুলাই। কারা যাবেন বৈঠকে যোগ দিতে? এআইসিসি নামের তালিকা চেয়েছিল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছেই। কিন্তু অধীর তালিকা তৈরির ভার এআইসিসি-র উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন বলে বিধান ভবন সূত্রের খবর। দিল্লিই স্থির করুক বাংলার কোন কোন নেতার সঙ্গে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি কথা বলবেন। সেই অনুযায়ী দিল্লি থেকেই ফোন করে ডেকে নেওয়া হোক প্রত্যেককে। এমনই প্রস্তাব দিয়েছেন অধীর। তবে কাদের ডাকা উচিত, সে সম্পর্কে নিজের পরামর্শ এআইসিসি-কে অধীর জানিয়েছেন। বাংলা থেকে নির্বাচিত প্রত্যেক কংগ্রেস সাংসদ এবং বাংলার প্রত্যেক কংগ্রেস বিধায়ককে বৈঠকে ডাকা উচিত বলে অধীরের মত। প্রাক্তন সাংসদ-বিধায়কদেরও ডাকা হোক, মত প্রদেশ সভাপতির। এঁদের বাইরে প্রদেশ কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য মুখ হিসেবে যাঁদের মনে করে দিল্লি, তাঁদের সকলকেই ডাকা হোক। এমনই প্রস্তাব গিয়েছে বিধান ভবন থেকে।

অধীর চৌধুরীর প্রস্তাব মেনে যদি ফোন আসতে শুরু করে দিল্লি থেকে, তা হলে ৬ জুলাই রাহুলের সামনে বাংলার কংগ্রেসের বেশ বড়সড় দলই হাজির হবে।

বিবেকানন্দের জন্মভিটেয় কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ। নিজস্ব চিত্র।

মূলত লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই বৈঠক ডেকেছেন রাহুল। সব রাজ্যের সাংগঠনিক পরিস্থিতিই পর্যালোচনা করবেন তিনি। ৬ জুলাই বাংলার পালা। রাজ্যে কংগ্রেসের যা শক্তি, তাতে লোকসভা নির্বাচনে একলা লড়লে সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা, সে বিষয়ে রাহুল প্রদেশ নেতৃত্বের মতামত নেবেন। প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে কারা একা লড়ার পক্ষপাতী, কারা বামেদের হাত ধরতে চান, কারা তৃণমূলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চান— সে সবও রাহুল বিশদে বোঝার চেষ্টা করবেন বলে খবর। তার ভিত্তিতেই রাহুল গাঁধী স্থির করবেন, ২০১৯ সালে বাংলায় দলের রণকৌশল কী হবে।

আরও পড়ুন: মাদক চক্রেও চিন যোগ? কলকাতা স্টেশনে ২ কুইন্টাল ড্রাগ-সহ ধৃত ৫ চিনা নাগরিক

আবার ২০১৬-র মতো বাম-কংগ্রেস সমঝোতা, নাকি ২০০৯ বা ২০১১-র মতো কংগ্রেস-তৃণমূল জোট— সিদ্ধান্ত দিল্লিই নেবে, অধীর চৌধুরী নন। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ অধীরের নেতৃত্ব আর মানতে নারাজ। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে রয়েছেন বহরমপুরের সাংসদ। বিধান ভবন সূত্রের খবর, প্রদেশ কংগ্রেসের দুই প্রাক্তন সভাপতির অনুগামীরা অধীরকে আর নেতৃত্বে চাইছেন না। প্রদেশ সভাপতি পদে অবিলম্বে বদল আনা হোক, নতুন সভাপতির নেতৃত্বে ভোটে যাওয়া হোক— এমন দাবি রাহুল গাঁধীর কাছে তাঁরা পৌঁছে দিয়েছেন বলে খবর।

অধীরের বিরুদ্ধে যাঁরা সুর চড়িয়েছেন, তাঁদের বক্তব্যের সারকথা কী? তাঁরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছেন যে, অধীর চৌধুরী স্বেচ্ছাচারীর মতো দল চালান, তিনি অন্যদের মতামত নেন না। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে ৪২টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। কিন্তু তার পরে একের পর এক কংগ্রেস বিধায়ক তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। অধীরের নিজের গড় মুর্শিদাবাদেও বিরাট ভাঙনের মুখে দল। এই ভাঙনকে অধীরের ব্যর্থতা হিসেবেই তুলে ধরতে চাইছেন দলীয় সমীকরণে অধীরের বিপরীত মেরুতে থাকা নেতারা।

আরও পড়ুন: সরকারের চাপে মাথা নোয়ালো যাদবপুর, ভর্তি নম্বরের ভিত্তিতেই

এই সব অভিযোগ অবশ্য অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে নতুন তোলা হচ্ছে না। আগেও বহু বার এ সব অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সনিয়া গাঁধী বা রাহুল গাঁধী অধীরেই আস্থা রেখেছেন। এ বার তাই লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন কেউ কেউ। খবর কংগ্রেস সূত্রেই। কংগ্রেসের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ বিজেপি, তাই বিজেপি-কে রুখতে অন্য সব ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সঙ্গে হাত মেলানো দরকার— বলছে প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ। তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে লোকসভা ভোটে যাওয়াই শ্রেয়, বলছেন তাঁরা। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের মাথায় অধীরকে রেখে তৃণমূলের সঙ্গে জোট অসম্ভব, তাই অধীরকে সরিয়ে দেওয়া হোক— এমন দাবি নানা ভাবে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নয়াদিল্লিতে।

কংগ্রেস সূত্রের খবর, রাহুল গাঁধী এত সরলীকৃত তত্ত্বের উপরে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন না। তিনি বাংলা কংগ্রেসের সব শিবিরকে সামনাসামনি নিয়ে বসতে চাইছেন। খোলাখুলি আলোচনার ভিত্তিতে নির্বাচনী রণকৌশল চূড়ান্ত করার পথে এগোতে চাইছেন। তবে তার আগে রাহুল বুঝে নিতে চাইছেন, বাংলায় কংগ্রেসের সাধারণ কর্মীরা কী চাইছেন।

আরও পড়ুন: ‘আমাদের কী হবে’? শিক্ষামন্ত্রীর অনলাইন নির্দেশেও আতান্তরে বহু ছাত্রছাত্রী

সাধারণ কর্মীরা কী চাইছেন, এ প্রসঙ্গে প্রদেশে কংগ্রেসের বিভিন্ন শিবিরের দাবি বিভিন্ন রকম। সেই কারণেই এআইসিসি পর্যবেক্ষক গৌরব গগৈ আগে ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কাটিয়ে গেলেন বলে জল্পনা। বাংলার কংগ্রেস কর্মীরা কী চান, তার আঁচ গৌরবও নিজের মতো করে পাওয়ার চেষ্টা করলেন। ৬ জুলাইয়ের বৈঠকের আগে নিজের উপলব্ধি তিনি রিপোর্ট আকরে পেশ করবেন রাহুল গাঁধীর সামনে।

তিন দিনের বাংলা সফরে গৌরব গগৈ গোটা বাংলায় দলের অবস্থা বুঝে ফেলেছেন বা দলের কর্মীদের মন পড়ে ফেলেছেন এমন নয়। তবে বাংলার নেতাদের নিয়ে রাহুলের বৈঠকের আগে গৌরব পরিস্থিতির একটা ঝটিতি আঁচ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রদেশ কংগ্রেসের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে এই ক’দিনে কথাবার্তা বলেছেন অসমের কলিয়াবরের তরুণ সাংসদ গৌরব গগৈ। চারটি সাংগঠনিক জেলায় তিনি কর্মীসভাও করেছেন। এই সব কর্মসূচির ভিত্তিতে তিনি যা বুঝেছেন, তা রাহুল গাঁধীর কাছে যে তিনি রিপোর্ট আকারে পেশ করবেন, সে কথা গৌরব অস্বীকার করেননি। ৬ জুলাইয়ের বৈঠকের আগেই যে তাঁর রিপোর্ট রাহুলের কাছে পৌঁছবে, গৌরব সে ইঙ্গিতও এ দিন দিয়েছেন।

আনন্দবাজার ডিজিটালকে গৌরব বুধবার বলেন, ‘‘নেতা হিসেবে নয়, এক জন সাধারণ কর্মী হিসেবেই এই ক’দিন ধরে আমি বাংলার কংগ্রেস কর্মীদের আশা-আকাঙ্খা বোঝার চেষ্টা করেছি। সে কথা কংগ্রেস সভাপতির কাছে পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য।’’

আরও পড়ুন: ভর্তি দুর্নীতির ধাক্কা, টিএমসিপি সভানেত্রী জয়াকে সরিয়ে দিলেন মমতা

গৌরব গগৈ নিজেকে ‘সাধারণ কর্মী’ আখ্যা দিলেও, প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ তাঁর আচরণে অখুশি। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান বেজায় চটেছেন গৌরবের উপরে। কংগ্রেস সূত্রের খবর, বুধবার মান্নানের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে তাঁকে ফোন করেছিলেন এআইসিসি-র পর্যবেক্ষক। কিন্তু মান্নান দেখা করেননি গৌরবের সঙ্গে।

গৌরব-মান্নান মনোমালিন্য নিয়ে কংগ্রেসের তরফে সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। কিন্তু মান্নান-ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, মঙ্গলবার মান্নানের জেলা হুগলিতে কর্মিসভা করেছেন গৌরব, অথচ মান্নানকে সেখানে ডাকা হয়নি। রাজ্যের কংগ্রেস বিধায়কদের সঙ্গেও গৌরব গগৈ বৈঠক করেছেন। কিন্তু কার কার সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন, সে বিষয়ে বিধায়ক দলের নেতা মান্নানের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হয়নি। এই সব কারণেই বুধবার গৌরবের ফোন পেয়েও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন বিরোধী দলনেতা। খবর কংগ্রেস সূত্রের।

আবদুল মান্নান নিজে অবশ্য অন্য কথা বলেছেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যখন ফোন করা হয়েছিল, তখন আমি লোকাল ট্রেনে ছিলাম। খুব আওয়াজ হচ্ছিল চারপাশে, কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। তাই বলেছি, পরে ফোন করব।’’

সব মিলিয়ে এ ক’দিনে কী উপলব্ধি হল গৌরব গগৈ-এর? চারটি জায়গায় কর্মীসভা করে এবং প্রদেশ কংগ্রেসের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে কথা বলে কী বুঝলেন তিনি? তৃণমূলের সঙ্গে যেতে চাইছেন কংগ্রেস কর্মীরা? নাকি বামেদের সঙ্গে সমঝোতা চাইছেন? এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিলেন না অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের সাংসদ-পুত্র। বললেন, ‘‘সবে তো কাজ শুরু করলাম। সবার সঙ্গে কথা হয়নি। ব্লকে ব্লকে গিয়ে আমি কর্মীসভা করব। তার আগে কিছু বলা উচিত হবে না।’’ তা হলে রাহুলকে দেওয়া রিপোর্টে কী লিখবেন? গৌরবের সহাস্য জবাব, ‘‘নিশ্চিত থাকুন, বাংলার কংগ্রেস কর্মীদের আশা-আকাঙ্খার কথাই লিখব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE