Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বাসীরাই ব্যথিত রামের নামে হিংসায়

বছর দেড়েক আগে আসানসোলে গোষ্ঠী-সংঘর্ষের সময়ে এক ভিডিয়োয় দৃষ্টিহীন ভিক্ষাজীবী ও তাঁর স্ত্রীকে জবরদস্তি ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে চাপ দেওয়া হচ্ছে, দেখা যায়। ‘যিনি ঈশ্বর, তিনিই আল্লা’ বলে কাকুতি-মিনতি করেও রেহাই পাচ্ছেন না তাঁরা।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৯ ০৩:৫৫
Share: Save:

কথা হচ্ছিল বাঁকুড়া জেলার এক তরুণ রাজস্ব অফিসারের সঙ্গে। মোটরবাইকে যেতে যেতে দাড়ির জন্য সম্প্রতি ‘জয় শ্রী রাম’-হাঁক দিয়ে টিটকিরি শুনতে হয়েছে তাঁকে।

ওই তল্লাটের একটি স্কুলের ইতিহাস শিক্ষকও স্তম্ভিত! তিনি ক্লাসে পিছনে ঘুরলেই কোরাস, ‘জয় শ্রী রাম’। “এ তো সামান্য দুষ্টুমি নয়। আমি অন্য ধর্মের বলেই ওদের শেখানো হয়েছে, আমায় জয় শ্রী রাম বলে উত্ত্যক্ত করতে,” বলছেন মাস্টারমশাই। রাম বা রামায়ণের গল্প তাঁর বহু দিনের জানা, রাম নামে বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই তবু স্কুলপড়ুয়া ছাত্রের মধ্যে চারিয়ে ওঠা বিদ্বেষের প্রবণতা কী ভাবে দূরে হটাবেন ভেবে পাচ্ছেন না ওই শিক্ষক।

হাওড়ার একটি কলেজের অধ্যাপক তথা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণসংগঠন ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’-এর কর্ণধার সামিরুল ইসলাম বিচলিত, ‘‘সবাইকে বলছি, প্ররোচনার ফাঁদে পা দেবেন না।’’ বছর দেড়েক আগে আসানসোলে গোষ্ঠী-সংঘর্ষের সময়ে এক ভিডিয়োয় দৃষ্টিহীন ভিক্ষাজীবী ও তাঁর স্ত্রীকে জবরদস্তি ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে চাপ দেওয়া হচ্ছে, দেখা যায়। ‘যিনি ঈশ্বর, তিনিই আল্লা’ বলে কাকুতি-মিনতি করেও রেহাই পাচ্ছেন না তাঁরা। সামিরুলের হিসেব, এই জুলুম বাড়ছে। লোকসভা ভোটের পরে বিভিন্ন জেলায় ১২-১৪টি ঘটনায় ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি তুলে অশান্তি বাধানোর চেষ্টা হয়েছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ।

কান্দিতে মুসলিম টোটোচালকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে গোলমালের পরে জনৈক যাত্রীর ‘জয় শ্রী রাম’ আস্ফালন এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরে স্কুলের ফুটবল ম্যাচে এই স্লোগানের পর সংঘর্ষের উপক্রম হয়। মালদা-বর্ধমান ডাউন ট্রেনে ‘জয় শ্রী রাম’-ধ্বনি থেকে উত্তেজনা ছড়ানোর পরে নিরীহ যাত্রীরাও মার খান।

কয়েকটি ঘটনায় অ-মুসলিমেরাও ছাড় পাচ্ছেন না। বাঁকুড়ার এক পুলিশ কনস্টেবলকে মদ্যপ অবস্থায় কয়েক জন ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলেছিলেন বলে শোনা গিয়েছে। ইট ছুড়ে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সোদপুরের ঘোলাতেও বিজেপি কর্মীরাই কয়েক জন কলেজছাত্রকে ধরে ‘জয় শ্রী রাম’ বলানোর জুলুম সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রেরা ধর্মে হিন্দু। কিন্তু নেতাদের সভার জন্য মাঠ পরিষ্কার না-করে গাজোয়ারির শিকার হন বলে অভিযোগ। স্থানীয় বিজেপি অবশ্য এই ঘটনায় তাদের যোগ মানতে চায়নি।

এত শত ঘটনার সূত্রে ‘জয় শ্রীরাম’-ধ্বনি স্পষ্টতই ‘হেট স্পিচে’র আদলে বা ঘৃণা ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ ইলেকশন ওয়াচ মঞ্চের কোঅর্ডিনেটর উজ্জ্বয়িনী হালিম। তাঁর কথায়, “এই ধরনের প্রবণতা অসাংবিধানিক কাজ ও ফৌজদারি অপরাধ। ভোটের প্রচারে হেট স্পিচ এড়াতে নির্বাচন কমিশন সক্রিয় থাকে, অন্য সময়েও পুলিশি কড়াকড়িটা জরুরি।”

কারও কারও মত, এই পরিস্থিতিতে সংখ্যাগুরু সমাজের প্রতিবাদী ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, গোরক্ষার নামে মুসলিমদের খুনের প্রতিবাদে দানা বাঁধে ‘নট ইন মাই নেম’ আন্দোলন। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান ব্যবহার করে পর পর হিংসার ঘটনায় বিশ্বাসী হিন্দুরাও অনেকেই বিরক্ত। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘রাম হলেন ভালবাসা, সহিষ্ণুতার প্রতীক। রামের নাম করে হিংসা কখনওই চলতে পারে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE