পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত-রাজ বামফ্রন্টের আমলে ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হয়I গ্রামীণ উন্নয়নের মূল অক্ষ ছিল এই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাI দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মল মুখোপাধ্যায় কমিটি (১৯৯৪) এই পঞ্চায়েতকে— দেওয়ালের মত খাড়া হয়ে থাকা আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে— সামনের থেকে সরাসরি প্রত্যাঘাত বলে মত দিয়েছিলেনI জেলাশাসক এবং বিডিও-র ক্ষমতার সমান্তরালে জেলা সভাধিপতি, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়I
সাধারণ গ্রামের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত পঞ্চায়েত যে উপর থেকে চাপানো আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন থেকে অনেক বেশি কার্যকরী, তা পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংস্কার ও কৃষি অগ্রগতির ইতিহাস থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছেI ১৯৯৪ সাল থেকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামসংসদ এবং গ্রামসভা মিটিং-এর মাধ্যমে গ্রামের পরিকল্পনা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রচনা করেন এবং সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব এই মিটিংগুলোয় অংশগ্রহণকারীদের সম্মতিতে সিদ্ধ হয়I
এর ফলশ্রুতিস্বরূপ বিগত আটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি উত্পাদন বৃদ্ধি পায় উচ্চহারে, যা সারা পৃথিবীব্যাপী পণ্ডিতদের মতে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত রাজ এবং এর মধ্য দিয়ে কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিলম্বিত সবুজ বিপ্লব সফল করার ফসলI
এর পর এল পরিবর্তন: পুনঃআমলাতান্ত্রিকরণ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই ঘোষণা করেন যে, পঞ্চায়েতকে আমলাতন্ত্রের অধীন হয়ে কাজ করতে হবেI প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ হেন অবস্থান সাময়িকI কারণ, ২০১১ সালে বেশির ভাগ পঞ্চায়েত বামেদের দখলে ছিলI কিন্তু যখন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের দখল সম্পূর্ণ হল, তখনও যখন মমতা একই অবস্থানে রইলেন, বোঝা গেল তাঁর নীতিই হল পুনঃআমলাতান্ত্রিকরণ (rebureaucratization)I
এটা অনুমেয় যে বাম আমলে বা সিপিএম-এর আমলে পঞ্চায়েতের নীতি রূপায়াণের জন্য তাদের সংগঠিত পার্টিকাঠামো খুব উপযোগী ছিলI কিন্তু মমতা প্রথম থেকে জানতেন তাঁর দলে সে রকম কোনও কাঠামো নেইI এখানে সবাই নেতা এবং সারদা-নারদা থেকে শুরু করে ছোট বড় মাঝারি নেতারা প্রায় সবাই নানা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তI সুতরাং পঞ্চায়েতের সরকারি টাকা যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে খরচ করা হত, তৃণমূলের অভ্যন্তরে এক মুষল-পর্ব অনিবার্যI সেই মুষল-পর্ব এড়িয়ে জনগণের হাতে কিছু সুযোগ-সুবিধা তুলে দেওয়ার তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য সংগঠন ছিল আমলাতন্ত্রI বিশেষত আমলাদের মুখ্যমন্ত্রীর সামনে রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনগণের সামনে জবাবদিহির নাটক দেখাতে হত, এবং মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে হত সব প্রকল্পের কাজ প্রায় ১০০% শেষ হয়ে গিয়েছেI সব মিলিয়ে পঞ্চায়েতের পুনঃআমলাতান্ত্রিকরণ একটি রাজনৈতিক সিধান্তI
কিন্তু সেটা করতে গিয়ে পঞ্চায়েত যে কারণে তৈরি হয়েছিল, অর্থাত্ আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের সঙ্গে জনগনের যে দুরত্ব তা তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কমানো, সেই লক্ষ্যটাই ভ্রষ্ট হয়ে গেলI এই আমলাতন্ত্র নির্ভর পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কিছুটা হয়ত প্রকল্পের টাকা মানুষের কাছে পৌঁছল, কিন্তু সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হল কৃষিI
কৃষি-সঙ্কট
বাম আমলে বাজারিকরণের প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাI কিন্তু এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কৃষকদের লেনদেনে যাতে কৃষকরা লোকসানে না পড়েন, তার দেখভাল করত পঞ্চায়েত এবং কৃষকসভাI মমতা এক দিকে পঞ্চায়েতের পুনঃআমলাতান্ত্রিকরণ করলেন, অন্য দিকে বাম কৃষক সভার হাতে মাথা কাটলেন, অথচ নিজের দলের বিচক্ষণ কৃষক সংগঠন তৈরি করতে ব্যর্থ হলেনI গ্রামাঞ্চলে কৃষক স্বার্থ দেখার ভরকেন্দ্র ধূলিসাত হয়ে গেলI বিষয়টা অনুধাবন করে মমতা আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পক্ষে সওয়াল করে বললেন— চালকল তথা বেনফেড, কনফেডের মত রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো সরকারি সহায়ক মূল্যে কৃষকদের থেকে ধান কিনতে বাধ্য থাকবেI একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উপর নেমে এলো নিষেধাজ্ঞাI চালকলগুলি অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের নির্দেশ অমান্য করে সহায়ক মূল্যে কৃষকদের কাছে ধান কিনতে অস্বীকার করেছে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রদত্ত চেক বাউন্স করেছেI বেনফেড ও কনফেড অর্থাভাবে প্রায় কিছুই ক্রয় করেনিI এই গোটা প্রক্রিয়ায় সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আলুচাষিরাI তাঁরা মহাজনদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা ধার করে আলুচাষ করেছিলেনI ২০১৭ সালে আত্মহত্যাকারী এক আলুচাষির পরিবার জানিয়েছেন এক ব্যাগ (৫০ কিলো) আলুচাষের খরচ হল ৩০০ টাকা, কিন্তু ফসল তোলার পর বাজারে সেই আলুর দাম দাঁড়াল বড়জোর ১৫০ টাকাI চাষিদের হিমঘর ভাড়া নেবার সামর্থ নেইI সরকার মুখে ঘোষণা করলেন— তাঁরা সব আলু চাষিদের থেকে কিনে নেবেনI বাস্তবে পচে যাওয়ার মুখে টন টন আলু গরু ছাগলকে খাইয়ে মহাজনি দেনা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় কৃষককেI সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হল, বাস্তবে ২০০-র কাছাকাছি কৃষক আত্মহত্যা করলেও মমতার সরকার কোনও রকম আত্মহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে, এবং এইসব তথ্য ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে পাঠায়নিI
এই কৃষি সংকট যাতে ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত না হয়, তাই বুঝি বিরোধীদের মনোনয়ন পেশ করতে না দেওয়ার এমন মরিয়া চেষ্টাI
(লেখক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি বিভাগের অধ্যাপক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy