পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার চলছে বলে দাবি করা হলেও দারিদ্র্যের নিরিখে আমাদের পছন্দের জায়গা মধ্যস্থলেই আছি।
গণতন্ত্রের নির্বাচন উৎসবে ‘উন্নয়ন’ বহুল ব্যবহৃত শব্দ, বেশি ব্যবহারে খানিক জর্জরিত। শাসক দাবি করে, ‘রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে’, এর জোরেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হবে, অন্য দিকে বিরোধীরা অনুন্নয়নের প্রশ্নে শাসকদলকে বিঁধতে চায়। তবে উন্নয়ন তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের মধ্যে ‘উন্নয়ন’ কী বা ‘উন্নয়ন সূচক’ কী হবে এ নিয়ে ঐকমত্য নেই। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা একটু বেশি করে মাথা ঘামান। এঁদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন রোজগার, আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান উন্নয়নের সূচক। অন্য দিকে, একদল মনে করেন দারিদ্র কেবল আয়ের অপ্রতুলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আয় বৃদ্ধি ঘটলেই মানব উন্নয়ন হবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। বরং শিক্ষার অভাব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা ও আয়ের সুযোগের অভাব, হিংসার, নিম্নমানের জীবনযাপন ইত্যাদি অনুন্নয়ন। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মানব উন্নয়নের দশটি সূচকের ব্যবহার ও বঞ্চনার ভিত্তিতে ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’ সূচক তৈরি করা হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’র সূচকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান কোথায় দেখে নিলে ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে ধারণাটা স্পষ্ট হবে।
রাষ্ট্রপুঞ্জ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’র মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের অনুপাত হিসাব করার পদ্ধতিকে অনুসরণ করে একটি গবেষণা হয়। সদ্য প্রকাশিত জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (এনএফএইচএস-৪) তথ্য ব্যবহার করে তিন জন গবেষক-অধ্যাপক এস পি সিংহ (আইআইটি রুরকি), আকর্ষ অরোরা এবং সিডনির ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক অ্যান্ড পিস-এর গবেষক মহম্মদ জাকারিয়া সিদ্দিকি দেখাচ্ছেন, ভারতীয় জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’-এর মধ্যে বসবাস করে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে এই হার ১৭ শতাংশ, অর্থাৎ, জাতীয় গড়ের থেকে মাত্র তিন শতাংশ কম। এই তথ্য অনুসারে, কেরলে ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’র মধ্যে বসবাস করে মাত্র এক শতাংশ মানুষ এবং এর পরে বড় রাজ্যগুলির মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি হিমাচল প্রদেশকে (৩.৮ শতাংশ)। বহুমাত্রিক দারিদ্রের মধ্যে বসবাস একবারে কম করে এমন রাজ্যগুলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানের বিস্তর ফারাক আছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের আগে প্রায় ১৯টি রাজ্য আছে। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান আছে ভারতের ‘মডেল’ রাজ্য বলে প্রচার চালানো গুজরাতের পাশাপাশি (১৬ শতাংশ)। ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’র মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের অনুপাতের শীর্ষে আছে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে (৪৩ শতাংশ), ঝাড়খণ্ড (৩৬ শতাংশ)।
আরও পড়ুন: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ইতিহাস গড়ে পৌনে ২ কোটি ভোটারকে বঞ্চিত করা হল
পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের জোয়ার চলছে বলে দাবি করা হলেও দারিদ্র্যের নিরিখে আমাদের পছন্দের জায়গা মধ্যস্থলেই আছি।
যে যে সূচকের উন্নতি হলে দারিদ্র হ্রাস পাবে তার মধ্যে শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাক্ষেত্রে আপাত ভাবে, বিশেষ করে শিক্ষা অধিকার আইন ২০০৯ চালু হওয়ার পর থেকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোর অংশগ্রহণ বেড়েছে ঠিকই, তবে এ রাজ্যে শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি হয়েছে। অভিভাবক ও শিশুদের মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়লেও শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত হতাশজনক হওয়ায় এক দিকে শিক্ষার গুণগত মান কমছে ও ছাত্রছাত্রীদেরও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে।
আরও পড়ুন: বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত শুধু বিরোধীদের হারানো নয়, দলের মধ্যের বিরোধিতাকেও চেপে দেওয়া
শিক্ষার উন্নতির জন্য পঞ্চায়েতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। স্থানীয় এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের স্থানীয় বাধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য পঞ্চায়েত সক্রিয় হতে পারত, এ ব্যাপারে পঞ্চায়েতের সক্রিয় উদ্যোগ চোখে পড়েনি। শিক্ষা অধিকার আইন ২০০৯ অনুসারে বিদ্যালয় পরিচালন ব্যবস্থায় স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ জরুরি। পঞ্চায়েত স্তরে রাজনীতির কূটকচালিতে এ রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি গড়ে ওঠেনি। এই বিষয়গুলো নিয়ে পঞ্চায়েত সক্রিয় হতে পারত, তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘শিক্ষা’ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেনি। প্রকৃত উন্নয়ন থেকে অনেকে দূরে থাকব যত দিন না শিক্ষার সুযোগ ও বঞ্চনা নিয়ে পঞ্চায়েত স্তরে আলাপ আলোচনা হবে।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও আমরা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে রাজ্য সরকারের সমস্ত উদ্যোগই হাসপাতালমুখী। পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়া জেলায় জেলায় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে, ন্যায্যমূল্যে ওষুধের ব্যবস্থা করা যা ইতিমধ্যে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে, তবে গোড়র গলদ থেকেই গেছে। রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্য বিধান গড়ে তোলার জন্য জনস্বাস্থ্য নিয়ে কোনও আলোচনা শোনা যায় না, এ নিয়ে বাজেট বরাদ্দও বেশ কম, বাজেট থাকলেও এর বাস্তবায়ন কম। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় রাজ্যের অবহেলার ফল ডেঙ্গু মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের হিমসিম খাওয়া। জনস্বাস্থ্যকে মানুষের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, থাকতে হবে জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি না হলে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হবে না। ২০০৫-’০৬ থেকে ২০১৫-’১৬ সালে ‘বহুমাত্রিক দারিদ্র’র মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষের অনুপাত লক্ষণীয় ভাবে কমেছে, সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের থেকে প্রায় ১৯টি রাজ্য আগে আছে।
‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়ন’-এর সূচক দেখা যায় পরিকাঠামোগত উন্নতি দেখে। বর্তমান শাসকদের ঘোর নিন্দুকেরাও এই কথা স্বীকার করছেন, কলকাতা শহরের পাশাপাশি জেলার রাস্তাঘাটের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। জেলা সদরের আগের জমানায় আগাছা গজিয়ে ওঠা সরকারি ভবনগুলোতে নীল-সাদা রঙের পোঁচ জ্বলজ্বল করছে। এমনকী, জেলায় জেলায় সরকারি উদ্যোগে মুসলমান, তফসিলি জাতি ও জনজাতি গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের জন্য ছাত্রাবাস তৈরি হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলোর ফলে সাধারণ মানুষের কী উন্নতি হচ্ছে তা জানতে একটু কষ্ট করতে হবে। ইমারত নির্মাণে যুক্ত অনেকেই আর্থিক ভাবে উন্নতি করেছে, কিন্তু এমন পরিসংখ্যান কি আছে, এই সব সরকারি পেল্লায় ভবনের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কি না? দেখতে হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান কতখানি বেড়েছে। এটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়ালে দেখা যায় না। পরিসংখ্যান তো বলছে, এই সব ক্ষেত্রে আমরা ভারতবর্ষের গড়ের কাছাকাছি। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে খাতায়-কলমে নয়, অনুশীলনে শক্তিশালী করলে মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলির উন্নতি হতে পারে, সে অপেক্ষায় থাকবে রাজ্যবাসী।
(লেখক প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy