Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ছাত্র হত্যায় ছাত্র পরিষদকেই দুষলেন ভারতী

সবং সজনীকান্ত কলেজে ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটে বলে প্রায় নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। কৃষ্ণপ্রসাদ জানা নামে ওই ছাত্র পরিষদ সমর্থক খুনের প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার ‘বাংলা বন্‌ধ’ ডেকেছে কংগ্রেস।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

সবং সজনীকান্ত কলেজে ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই ছাত্র খুনের ঘটনা ঘটে বলে প্রায় নির্দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ।

কৃষ্ণপ্রসাদ জানা নামে ওই ছাত্র পরিষদ সমর্থক খুনের প্রতিবাদে আজ, মঙ্গলবার ‘বাংলা বন্‌ধ’ ডেকেছে কংগ্রেস। ঠিক তার আগেই এই মন্তব্য করে পুলিশ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা মামলা লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের।

সবং কলেজের ছাত্রমৃত্যুর তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে দাবি করে সোমবার এসপি বলে দেন, “কৃষ্ণপ্রসাদ জানার মৃত্যু হয়েছে গোষ্ঠী বিবাদের জেরেই। তার সব তথ্য ও প্রমাণ আমাদের কাছে এসে গিয়েছে।” বস্তুত, ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ভারতীদেবী এ দিন তাতেই সিলমোহর লাগালেন।

পুলিশের হাতে কি কোনও নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে?

পুলিশ সুপারের দাবি, কলেজের একাধিক ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, নিরাপত্তীরক্ষী আদালতে গিয়ে গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা আক্রান্ত হতে পারেন জেনে পুলিশই সেই ব্যবস্থা করেছিল। এ ছাড়াও গোপন ক্যামেরার ছবি আছে। পুলিশের পক্ষ থেকে গোপনে একটি ‘কমপ্লেন বক্স’ রাখা হয়েছিল, সেখানেও ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের দেখা সব কিছু লিখিত ভাবে জানিয়েছেন। সন্দেহভাজন ছাত্রের উপর নজরদারি করেও তথ্য মিলেছে।

পুলিশ সূত্রের দাবি, সন্দেহভাজন ছাত্রটির মোবাইলের কথোপকথন গোপনে রেকর্ড করে তারা জেনে ফেলেছে, সে-ই কৃষ্ণপ্রসাদকে খুন করেছিল। তা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? তার নামই বা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যা, “তদন্ত শেষ পর্যায়ে, কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। ক’দিন পরেই সব প্রকাশ পাবে।”

কৃষ্ণপ্রসাদের ভাই হরিপদ জানার প্রতিক্রিয়া, “কংগ্রেস বা সিপিএমের উপরে যতই দোষ চাপানোর চেষ্টা হোক, আমার বিশ্বাস, টিএমসিপি-র ছেলেরাই দাদাকে খুন করেছে।” সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার আক্ষেপ, ‘‘যে ভাবে তদন্ত এগোচ্ছে, সুবিচারের কোনও আশা নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কথা মতোই মামলা সাজাচ্ছেন তাঁর পুলিশ সুপার।’’

গত ৭ অগস্ট সবং কলেজে ছাত্র সংঘর্ষের সময়ে মাথায় গুরুতর চোট পেয়ে মারা যান কৃষ্ণপ্রসাদ। তার পরেই মমতা বলে দেন, ইউনিয়ন রুম বন্ধ করে ভেতরে মারপিট হচ্ছিল এবং নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তিতেই মারা গিয়েছে ছেলেটি। সরাসরি তিনি কারও নাম না করলেও ওই কলেজের ছাত্র সংসদ ছাত্র পরিষদের দখলে, ফলে কারা ‘নিজেদের মধ্যে’ মারপিট করছিল, সেই ইঙ্গিত কার্যত পরিষ্কার।

ঘটনা হল, খুনের পরেই ছাত্র পরিষদের অভিযোগের ভিত্তিতে তিন টিএমসিপি সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশ যে মামলা রুজু করে, তাতে টিএমসিপি বনাম ছাত্র পরিষদের সংঘর্যের কথাও বলা হয়। কিন্তু তার পরেই ভারতীদেবী দাবি করেন, সিসিটিভি ফুটেজে অভিযুক্ত বা ধৃতদের দেখা যাচ্ছে না। পরের দিন সেই ফুটেজের একাংশ প্রকাশ্যে এলে অবশ্য কৃষ্ণপ্রসাদের সঙ্গে টিএমসিপি কর্মী শেখ মুন্নাকে (পরে ধৃত) ধস্তাধস্তি করতে দেখা যায়।

পুলিশ সুপার অবশ্য এ দিন একাধিক নথির উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, এক ছাত্রীর সঙ্গে দুই ছাত্র পরিষদ সমর্থকের বিবাদ ও ভর্তির জন্য ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলা নিয়ে ঝামেলার জেরেই গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়। পুলিশ সুপার প্রশ্ন তোলেন, কলেজে এক ছাত্র পরিষদ সমর্থককে পেটানো হচ্ছে, তবুও ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পুলিশকে জানাননি কেন? আহত কৃষ্ণপ্রসাদকে প্রথমেই হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে ইউনিয়নের মেম্বার রুমে প্রায় সাড়ে ৮ মিনিট ফেলে রাখা হল কেন? কেন জামা প্যান্ট খুলে ফেলা হল? তার পরেই কি সাধারণ সম্পাদক ইউনিয়ন রুমের সামনের গোপন ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে ইউনিয়ন রুমে থাকা লাঠি গুলি জানালা দিয়ে ফেলে ফের ক্যামেরার মুখ ঠিক করলেন?

পুলিশ সুপার বলেন, “আমরা সেই সব লাঠি ও কৃষ্ণপ্রসাদের রক্তমাখা জামাপ্যান্ট উদ্ধার করেছি। ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করলেই সব বেরিয়ে যাবে।” কেন এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? পুলিশ সুপার জানান, সঠিক সময়েই তা করা হবে। তাঁর দাবি, যে ১৪ জন ছাত্র পরিষদ সমর্থকের হাতে মোটা লাঠি দেখা গিয়েছিল তাদের সিংহ ভাগ বহিরাগত। তারা জবরদস্তি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলে। তা দিয়ে কেউ কেউ গাড়ি-বাড়িও কিনেছে।

পুলিশের দাবি, প্রথমে যে চেয়ারে এক ছাত্রের বসাকে কেন্দ্র করে বিবাদ শুরু হয়েছিল, তা দুপুর ১টা ৩ মিনিটে মিটে গিয়েছিল। দ্বিতীয় দফায় বিবাদ শুরু হয় গ্রন্থাগারে। সেখানে টিএমসিপি সমর্থক দিলীপ মণ্ডলকে মারধর করা হয়। সেখানে হাজির ছিলেন কৃষ্ণপ্রসাদও। তবে তাঁর হাতে লাঠি ছিল না। তিনি যখন দিলীপের কাছে যান তখনই পিছন দিক থেকে তাঁকে লাঠির আঘাত করা হয়। তার পরে মাটিতে ফেলেও মারধর চলে। পুলিশ সুপার বলেন, “পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিলে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই আদালতে জবানবন্দি, গোপন ক্যামেরার ছবি ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করার পরে তদন্ত শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।”

কিন্তু এ প্রশ্নও তো উঠতে পারে, পুলিশ ও শাসকদলের ভয়েই অনেকে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন? পুলিশ সুপারের দাবি, “জবানবন্দির সঙ্গে আমরা গোপন ক্যামেরার ছবি দেখে মিলিয়েছি। প্রথমত, মিথ্যে বললে একাধিক জবানবন্দি এক হতে পারে না। ঘটনাক্রমো ক্যামেরার ছবির সঙ্গে মিলতে পারে না।”

ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মহম্মদ সইফুলের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রীর কথাকে মান্যতা না দিলে যে পদোন্নতি আটকে যাবে! কোনও পুলিশ আধিকারিক এতটা মেরুদণ্ডহীন হতে পারেন, ভাবতেও লজ্জা করে।” আইনের প্রতি তাঁদের আস্থা আছে জানিয়ে জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া বলেন, “পুলিশ তো এ রকম অনেক কিছুই বলতেই পারে। আদালতেই প্রমাণ হবে, কে বা কারা এই খুনের সঙ্গে যুক্ত। আর পুলিশেরই বা ভূমিকা কী!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE