অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
শাসক দলের সঙ্গে সঙ্ঘাত যত তীব্র হচ্ছে, ততই বাড়ছে সঙ্কট। কলকাতার উত্তর শহরতলিতে তাই ঝান্ডা লাগানোর আগেও দশ বার ভাবতে হচ্ছে বিজেপি নেতাদের।
প্রথমে নির্ধারিত দিনে বৈঠকই করতে পারেনি বিজেপির জেলা কমিটি। বৈঠকের জন্য ভাড়া নেওয়া হল থেকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয়েছিল বিজেপি নেতাদের। প্রতিবাদে ডেপুটি কমিশনারের (ডিসি) দফতরের সামনে অবস্থান করতে গিয়ে ‘গুলি চালানো’র শাসানি শুনতে হয়েছিল বলে বিজেপির অভিযোগ। অবশেষে সেই বৈঠক হল। কিন্তু পতাকা উত্তোলনটাও করতে হল লুকিয়ে-চুরিয়ে।
বৃহস্পতিবার বিজেপির উত্তর শহরতলি সাংগঠনিক জেলা কমিটির কার্যকারিণী বৈঠক ছিল। বৈঠকটি আয়োজিত হয় ঘোলা এলাকায় একটি হল ভাড়া নিয়ে। কিন্তু বৈঠকের আগে পতাকা উত্তোলনটা প্রকাশ্যে করেনি বিজেপি। হলের ভিতরে পতাকা উত্তোলন হয়েছে। তার পরে যতটা সম্ভব নিশ্চুপে বৈঠক সেরেছেন বিজেপির জেলা নেতারা। তৃণমূলের নজর এড়াতেই এই রকম চুপিসাড়ে সারতে হয়েছে জেলা কার্যকারিণীর কাজ। রাজ্য বিজেপির একটা অংশই এমনটা জানাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘আপনি কর্মীদের মনোবল ভেঙে দিচ্ছেন’ মুকুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন দিলীপ ঘোষ
বিজেপির এই জেলা কার্যকারিণী বসার কথা ছিল গত ২ অক্টোবর। কিন্তু উত্তর শহরতলি জেলা কমিটির সভাপতি মানস ভট্টাচার্যের পিতৃবিয়োগের কারণে সে দিন বৈঠক বাতিল করতে হয়। স্থির হয়, ৬ অক্টোবর বৈঠক হবে। সেই অনুযায়ী, নিমতা থানা এলাকায় একটি অনুষ্ঠান বাড়িতে সভার তোড়জোড় সকাল ১০টা থেকে শুরুও হয়েছিল। কিন্তু সাড়ে ১০টা নাগাদ স্থানীয় কিছু লোকজন সেখানে পৌঁছন এবং সভার কাজ পণ্ড করে দেন।
বিজেপির দাবি, নিমতার ওই হলে বিজেপির সভা পণ্ড করতে যাঁরা গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই তৃণমূলের লোক। উত্তর শহরতলি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি মানস ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘তৃণমূলের লোকজন প্রথমে বাড়ির মালিকের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। বিজেপি-কে হল ভাড়া দেওয়া হয়েছে কেন, সে প্রশ্ন তুলে বাড়িটির মালিককে শাসানো হয়। তার পরে আমাদের দলের কর্মীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি শুরু করেন। হল থেকে বেশ কয়েক জনকে ধাক্কা মেরে বার করে দেওয়া হয়। ওই পরিস্থিতিতে বৈঠক হওয়া আর সম্ভব ছিল না।’’
এ ভাবেই ঘরের ভিতর পতাকা তুলে বিজেপির উত্তর শহরতলি সাংগঠনিক জেলা কমিটির কার্যকারিণী বৈঠক হল। নিজস্ব চিত্র।
মানসবাবুর আরও অভিযোগ যে, নিমতা থানার আইসি কোনও ভাবেই সাহায্য করতে রাজি হননি। তাই রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি (জোন-২) আনন্দ রায়ের অফিসে যান তাঁরা। সেখানে বিক্ষোভ শুরু হয়। তখনই আনন্দ রায় গুলি চালানোর হুমকি দেন বলে মানস ভট্টাচার্যের অভিযোগ। মানসবাবুর কথায়, ‘‘ডিসি আমাদের বলেন, এখানে ১৪৪ ধারা রয়েছে। সরে না গেলে গুলি চালানো হবে।’’
৬ অক্টোবর যে বৈঠক ভেস্তে গিয়েছিল, ১১ অক্টোবর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বিজেপির সেই কার্যকারিণী বৈঠক অবশেষে হয়েছে। কিন্তু ঘোলা এলাকার একটি বাড়িতে আয়োজিত সেই বৈঠকও শেষ পর্যন্ত হতে দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব সন্দিহান ছিলেন বলে দলেরই একাংশের দাবি। বৈঠকের আগে অনুষ্ঠান বাড়ির সামনে কোনও হইচই বা তৎপরতা দেখা যায়নি। হলের ভিতরে পতাকা উত্তোলন করে কার্যকারিণী বৈঠক শুরু করা হয়।
বিজেপির নেতাদের কেউই অবশ্য প্রকাশ্যে বলছেন না যে, তৃণমূলের নজর এড়াতেই হলের ভিতরে পতাকা উত্তোলন করে কার্যকারিণী শুরু করা হয়েছে। রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বলেছেন, ‘‘পতাকা উত্তোলন করে জেলা কার্যকারিণী শুরু করতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। পতাকা উত্তোলন প্রকাশ্য স্থানে করতে হবে, তেমনও কোথাও বলা নেই।’’ আর জেলা সভাপতি মানস ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘যে বাড়িতে আমরা বৈঠক করছিলাম, তার সামনে পতাকা উত্তোলনের মতো জায়গা ছিল না। পার্কিং-এর মাঝখানে তো পতাকা তোলা সম্ভব নয়। তাই ভিতরেই পতাকা উত্তোলন হয়েছে।’’ কিন্তু বিজেপির রাজ্য স্তরের বেশ কয়েক জন নেতা আড়ালে মেনে নিচ্ছেন যে, আবার যাতে বৈঠক ভেস্তে না দেয় তৃণমূল, তা নিশ্চিত করতেই হলের ভিতরে পতাকা তোলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোনে কথা নয়, নির্দেশ কৈলাসের
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। নিমতার বৈঠক তৃণমূল ভেস্তে দিয়েছিল বলে যে অভিযোগ বিজেপি করছে, তা উড়িয়ে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলছেন, ‘‘আমাদের জেলায় জনগণ বিজেপির সঙ্গে নেই। আমরা বিজেপিকে নিয়ে তাই ভাবি না। বিজেপিকে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিজেপির কোনও বৈঠক তৃণমূল ভেস্তে দেয়নি। ভবিষ্যতেও দেবে না।’’ জ্যোতিপ্রিয় আরও বলেন, ‘‘বিজেপি তো উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় সভা করেছে। দিলীপ ঘোষ তো বনগাঁয় সভা করতে গিয়ে আকথা-কুকথা বলে এসেছেন। একটা ঢিলও কেউ ছোড়েনি। ওঁরা চাইছেন যে, তৃণমূল এমনটা করুক। তা হলে মানুষের সহানুভূতি টানার একটা সুযোগ ওঁরা পাবেন। কিন্তু আমরা সে ফাঁদে পা দেব না।’’
ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডিসি (জোন-২) আনন্দ রায়ও বিজেপির যাবতীয় অভিযোগ নস্যাৎ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘নিমতায় যে ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না। ওটা বাড়ি মালিকের সঙ্গে বিজেপির ব্যাপার।’’ আর গুলি চালানোর শাসানি দেওয়া হয়েছে বলে যে অভিযোগ বিজেপি করেছে, সে প্রসঙ্গে ডিসি বলেন, ‘‘ওঁরা প্রথম যে দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, আমি সে দিন অফিসে ছিলামই না। তাই গুলি চালানোর হুমকি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে সে দিন বিক্ষোভকারীরা সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়তে চাইছিলেন বলে জেনেছি। সেখানে ঢুকতে ওঁদের বারণ করা হয়েছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy