Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিজেপি-র আইন অমান্যে ধুন্ধুমার, জখম কেন্দ্রীয় নেতারাও

বিজেপি-র আইন অমান্য ঘিরে ধুন্ধুমার অব্যাহত থাকল বৃহস্পতিবারও। নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েনে সাময়িক বিরতির পর বিজেপি-র তরফে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা আরও কয়েক ধাপ এগোল এ দিন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ২৩:৩৫
Share: Save:

বিজেপি-র আইন অমান্য ঘিরে ধুন্ধুমার অব্যাহত থাকল বৃহস্পতিবারও। নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েনে সাময়িক বিরতির পর বিজেপি-র তরফে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা আরও কয়েক ধাপ এগোল এ দিন। যখন বারাসত ও কৃষ্ণনরে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মী-সমর্থদকের সঙ্গে পুলিশের প্রবল খণ্ডযুদ্ধ বাধল। জখম হলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে রাজ্যে দলের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, সহ-পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ও সুরেশ পূজারী, রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং দলের বহু কর্মী।

এখানেই শেষ নয়। খণ্ডযুদ্ধের জেরে যে সব বিজেপি কর্মীকে পুলিশ এ দিন গ্রেফতার করে, তাঁদের মুক্তির দাবিতে রাতে কৃষ্ণনগরের কোতোয়ালি থানার সামনে আহত অবস্থাতেই অনশন শুরু করেছেন দিলীপবাবু, কৈলাস, সুরেশ এবং সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তাঁদের আন্দোলনের উপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের পুলিশের আচরণ সম্পর্কে অবহিত করে এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে রাতেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন কৈলাস। তাঁর জীবন বিপন্ন বলে রাজনাথের কাছে লিখিত ভাবে আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন দিলীপবাবু। খবর পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং অমিত শাহের কাছেও। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে জীবন বিপন্ন বলে হইচই করতেন, সেই একই তাস এ বার মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন দিলীপবাবুরা!

রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার অবশ্য বক্তব্য, ‘‘পুলিশের দিকে ঢিল ঢুড়লে যে মামলা হয়, আইন মোতাবেক সেই মামলাই রুজু করা হয়েছে। নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখান থেকে সরে আসার এখনও কোনও কারণ ঘটেনি!’’ যার জবাবে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য আবার কটাক্ষ করেছেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা পুলিশকে আক্রমণ করেননি। আর আমাদের রাজ্যের পুলিশ বিরোধী দলের কর্মীদের ব্যাপারে যে অসহিষ্ণু এবং শাসক দলের চোর-তোলাবাজ-ধর্ষকদের আক্রমণের মুখে সহিষ্ণু, তার ছবি তো রোজই দেখছি!’’ পাশাপাশিই তিনি জানিয়েছেন, বিধানসভায় পুলিশের অসহিষ্ণুতা নিয়ে বলতে চেয়েও সুযোগ পাননি। দু’দিন ধরে যা ঘটল, তার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার কলকাতা-সহ রাজ্যের প্রতি ব্লকে বেলা ২টো থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত পথ অবরোধ হবে।

পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ এবং কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জখম হওয়ার জেরে বেশ কিছু দিন পরে রাজ্যে বিজেপি দৃশ্যমানতা পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে কিছু প্রশ্ন উঠছে দলের অন্দরেই। রাস্তায় নেমে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াই রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাওয়ার একমাত্র পথ কি না, চর্চা হচ্ছে দলের মধ্যেই। লোকসভা ভোটে রাজ্যে ভোট বাড়িয়ে ১৭%-এ পৌঁছে গেলেও পরবর্তী দেড়় বছরে স্থানীয় স্তরে সংগঠন বা বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন— কোনওটাই গড়ে তুলতে পারেনি বিজেপি। বারাসত, কৃষ্ণনগর বা শ্রীরামপুরে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থি্তিতে আইন অমান্য হচ্ছে, এই ছবিও সংগঠনের পক্ষে খুব আস্থাদায়ক নয় বলে মনে করছে দলের একাংশ। তাদের যুক্তি, স্থানীয় স্তরে নেতৃত্ব ও সংগঠনের অভাবই এতে স্পষ্ট! বিজেপি-র একটি সূত্রের আরও বক্তব্য, দিলীপবাবু সভাপতি হওয়ার পরে দলে এখন কর্তৃত্ব জোরালো হয়েছে সঙ্ঘ পরিবারের। যাবতীয় কর্মকাণ্ড ঘটছে তাদের অঙ্গুলি হেলনেই।

বিজেপি-র এক রাজ্য নেতা অবশ্য পাল্টা বলছেন, ‘‘রাহুল সিংহের সময় অভিযোগ উঠত, তিনি শুধু সাংবাদিক সম্মেলন করেন! রাস্তায় নেমে আন্দোলনে দলটাকে দেখা যায় না। এখন রাস্তায় নামতেই উল্টো কথা বলা হচ্ছে!’’ ওই নেতার দাবি, সরকারকে ব্যতিবস্ত করাই বিরোধী হিসাবে তাঁদের কাজ। তাঁরা সেটাই করেছেন। পুলিশই বরং ‘অসহিষ্ণুতা’র পরিচয় দিয়েছে বলে তাঁর দাবি। প্রসঙ্গত, আইন অমান্য ঘিরে কুরুক্ষেত্র বাধলেও প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবুকে কোথাও সেই কর্মসূচিতে দেখা যায়নি। তিনি এ দিন দার্জিলিঙের চকবাজারে ছিলেন বিজেপি-র একক সমাবেশে। তবে ১৪ থেকে ২১ ডিসেম্বরের এই ‘জেল ভরো’ কর্মসূচির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল রাহুলবাবুর আমলেই।

কৃষ্ণনগরে এ দিন ইট ও লাঠির আঘাতে পাঁচ জন সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ বিজেপি-র একাধিক নেতা-কর্মী জখম হন। তাঁদের শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের মাঠ লাগোয়া রাস্তায় এ দিন মঞ্চ বেঁধে সভা করার পর বিজেপি নেতারা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে জেলা প্রশাসন ভবনের দিকে রওনা হন। পথে পুলিশের দুটো ব্যারিকেড ছিল। প্রথম ব্যরিকেড ভেঙে ফেলেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। দ্বিতীয় ব্যারিকেড ভাঙতে যেতেই তাঁরা পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ব্যারিকেডটি ভেঙে যায়। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করে।

লাঠির আঘাতে মাথা ফাটে সুরেশের। এর পর দলের কর্মীরা পিছু হঠেন। সেই সময় পুলিশের দিকে ইট ছোড়া হয়। পাল্টা ইট ছোড়ে সিভিক ভলান্টিয়াররাও। তার পরই মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। সেই সময় কৈলাস, দিলীপবাবুরা রাস্তায় বসে পড়েন। ঘটনাস্থলে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজয় প্রসাদ। তাঁর নির্দেশে গ্রেফতার করা হয় বিজেপি-র ৪০ জন নেতা-কর্মীকে। থানায় নিয়ে গিয়ে কৈলাস, দিলীপবাবু-সহ ৩৬ জনকে ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি চার জনের মুক্তির দাবিতে থানার ভিতরে অবস্থান-বিক্ষোভ করে বিজেপি। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘ওঁদের গ্রেফতার করলে একই ধারায় আমাদেরও গ্রেফতার করতে হবে। না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামব।’’ পরে দিলীপবাবুরা অনশনে বসেন ধৃতদের মুক্তির দাবিতে। কৈলাস বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করতে পারত। তা না করে নির্বিচারে যে ভাবে লাঠি চালাল, তাতে ফের প্রমাণিত হল এ রাজ্যে কোনও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই।’’ পক্ষান্তরে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অজয় বলেন, ‘‘বিজেপি কর্মীরাই প্রথমে পুলিশের উপরে হামলা করেন। আমাদের কয়েক জন কর্মী গুরুতর জখম। পুলিশ আত্মরক্ষা করেছে মাত্র।’’

বারাসত জেলাশাসক অফিস চত্বরে দলের আইন অমান্য কর্মসূচিতে এ দিন পুলিশের লাঠির আঘাতে জখম হন সিদ্ধার্থনাথ, কেডি বিশ্বাস, তরুণ জোয়ারদার-সহ প্রায় ২৫ জন নেতা-কর্মী। তাঁদের কয়েক জনকে বারাসত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই ঘটনায় বারাসত থানার আইসি-সহ ১০ জন পুলিশ কর্মীও জখম হয়েছেন। বারাসতের রথতলায় জড়ো হয়ে বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা মিছিল করে জেলাশাসককে দাবিপত্র দিতে দফতরের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশ জানায়, কয়েক জন প্রতিনিধিকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে। অভিযোগ, দলের কর্মীরা সেই নির্দেশ না মেনে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশের প্রথম বেষ্টনী ভেঙে দ্বিতীয় ধাপে যাওয়ার পরে পুলিশ বাধা দেয়। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। পুলিশ লাঠি চালাতে শুরু করে। তাতেই পায়ে চোট পান সিদ্ধার্থনাথ। এর পর বিজেপি সমর্থকরা পুলিশকে ইট ছোড়ে বলে অভিযোগ। ইটের আঘাতে জখম হন পুলিশ-কর্মী। পাল্টা লাঠি চালায় পুলিশ। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সিদ্ধার্থনাথ বলেন, ‘‘শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ বিনা প্ররোচনায় লাঠি চালিয়েছে।’’ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তরুণ হালদার অবশ্য বলেন, ‘‘ওই দলের কর্মী সমর্থকরা জোর করে ঢুকতে গেলে ধাক্কাধাক্কি বাধে। তাতে মহিলা পুলিশ-সহ কয়েক জন পুলিশ কর্মী জখম হয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP leaders clash injury police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE