বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) নির্দেশিকা অনুযায়ী, রক্তদান শিবিরে উপহার দেওয়া নিষিদ্ধ। একই নির্দেশিকা রয়েছে ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)-এরও। কিন্তু তার পরেও সেই নির্দেশিকাকে অগ্রাহ্য করে উপহারের বিনিময়ে রক্ত সংগ্রহ চলছে অবাধেই। সোনাগাছির রক্তদান শিবিরেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রাজ্যের রক্তসুরক্ষার ছবিতে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। মঙ্গলবারই বেশ কয়েকটি ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তা স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
তাঁদের বক্তব্য, অধিকাংশ রক্তদান শিবিরেই এখন দামি উপহার দেওয়ার চল হয়েছে। ফলে বিষয়টা আর ‘দান’-এর পর্যায়ে থাকছে না, কার্যত বিক্রির পর্যায়েই পৌঁছেছে। এতে এখনই রাশ টানতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
শনিবারেও শিবিরে উপহার হিসেবে বড় ব্যাগ এবং নন স্টিক ফ্রাইং প্যান দেওয়া হয়েছিল। ওই শিবিরে সে দিন রক্ত দিয়েছেন এমন এক দাতা এ দিন বলেন, ‘‘কী উপহার দেওয়া হবে, সেটা দিন কয়েক আগে থেকেই প্রচার করা হচ্ছিল। দুটোই খুব দরকারি জিনিস। দামও বেশি। তাই আমরা অনেকেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের মধ্যে একজন মাস দেড়েক আগে আর একটি শিবিরে রক্ত দিয়েছিল। ক্লাবের ছেলেদের কাছে সে জানতে চেয়েছিল রক্ত দিতে পারবে কি না। ক্লাবের ছেলেরা জানিয়েছিলেন কোনও অসুবিধা নেই, সবাই রক্ত দিতে পারবে।’’
এই প্রবণতাকেই মারাত্মক বলে মনে করছেন ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্তারা। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রধান এ দিন স্বাস্থ্য ভবনে জানিয়েছেন, সপ্তাহ কয়েক আগে তাঁদের কর্মীরা উত্তর কলকাতার একটি ক্লাবের রক্তদান শিবিরে গিয়ে দেখেন সেখানে দাতাদের মোবাইল ফোন দেওয়া হচ্ছে। আর কাতারে কাতারে মানুষ রক্ত দেওয়ার জন্য লাইন দিয়েছেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ক্লাবকর্তাদের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত তাঁদের হার মানতে হয়েছিল।
বিষয়টা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের কর্তাদের একাংশও। এক কর্তা বলেন, ‘‘পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক বিভিন্ন ক্লাবকে টার্গেট দিয়ে রাখে। নির্দিষ্ট সংখ্যক ইউনিট রক্ত জোগাড় করতে পারলে ক্লাবের উন্নয়নে টাকা বা রঙিন টিভি দেওয়া হয়। ওই ক্লাবও দাতাদের আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে মোটা টাকার উপহার দেয়। ওই উপহারের লোভে এমন অনেকেই রক্ত দিতে আসেন যাঁদের দেওয়ার কথাই নয়।’’
রক্তদান আন্দোলন নিয়ে কাজ করছে যে সব সংগঠন, সেখানকার কর্মীদের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। এমনই এক সংগঠনের তরফে দীপঙ্কর মিত্র বলেন, ‘‘এমন অনেককে জানি যাঁরা ফি রবিবার কোথায় রক্তদান শিবিরে আয়োজন করা হচ্ছে, কোথায় কী উপহার দেওয়া হচ্ছে তার খবর নিয়ে বেড়ান। তার পর সেই অনুযায়ী তাঁরা ঠিক করেন কোথায় যাবেন।’’ এর ফলে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান না রেখেই অনেকে পর পর রক্ত দেন। অনেকে নিজেদের কোনও অসুখ থাকলে সেটাও গোপন করে ফেলেন।
ন্যাকো-র এক কর্তা মঙ্গলবার দিল্লি থেকে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। আমরা বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ পাচ্ছি। রাজ্য এডস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সমিতি (স্যাক্স)-কে আমরা এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারও করেছি বহু বার। প্রয়োজনে আবার করব।’’ কেন স্যাক্স এ ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করছে না? স্যাক্স কর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ক্লাব সম্পর্কে অভিযোগ আসে। তাঁরা সেগুলি খতিয়েও দেখেন। গত কয়েক মাসে এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ এসেছে যেখানে কয়েকটি বেসরকারি ব্লাড ব্যাঙ্ক উপহারের ব্যবস্থা করে রক্তদান শিবির করেছে। এর মধ্যে কয়েকটিতে আবার দাতার রক্তের গ্রুপ ভুল লেখা হয়েছিল। ওই ব্যাঙ্কগুলির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। ক্লাবগুলিকেও সতর্ক করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, এ রাজ্যে রক্তদান আন্দোলনে জোয়ার আসে মূলত আশির দশকের শুরুতে। ১৯৮৭-’৮৮ সাল নাগাদ বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ার সময়ে তা আরও বড় আকার নেয়। কিন্তু তার অল্প সময় পর থেকেই উপহারের চল শুরু হয়। মধ্য কলকাতায় এই চল শুরু করেছিলেন মূলত প্রয়াত অজিত পাঁজা। ২০০৯-এর পর থেকে বামপন্থী সংগঠনগুলি দুর্বল হতে শুরু করার পরে রক্তদান শিবিরের সংখ্যা কমতে থাকে। আর তখনই দাতার সংখ্যা বাড়াতে উপহারের কথা ভাবা হয়।
তবে এর ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়। সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কগুলির নথি থেকেই জানা যাচ্ছে, গত মাসেই উত্তর কলকাতার একটি ক্লাব আয়োজিত শিবিরে ৫৫০ জন রক্তদান করেন। সেখানে কোনও উপহারের ব্যবস্থা ছিল না। মধ্য কলকাতার একটি সংগঠন শিবিবের আয়োজন করার সময়ে ব্যানারেই লিখে দিয়েছিল, কোনও উপহার দেওয়া হবে না। তবুও সেখানে ৩২৫ জন রক্ত দিয়েছেন।
এ দিকে, শুধু উপহার নয়, সোনাগাছিতে রক্তদান শিবিরের আয়োজন হল কেন, সেই প্রশ্ন তুলেও এ দিন প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছে। বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারও সোনাগাছিতে রক্তদান শিবিরের প্রতিবাদে মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাঁর দাবি, অবিলম্বে ওই শিবির থেকে সংগৃহীত রক্ত নষ্ট করে ফেলা হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy