Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মা-বাবাকে ফিরে পেল, এটাই ইমামুলের বড়দিনের উপহার

সে ছিল হারিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট মেয়েকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। বজরঙ্গি-র হাত ধরে ছোট্ট শাহিদা ফিরে পেয়েছিল বাবা-মাকে। শাহিদা কথা বলতে পারত না। কিন্তু, ইমামুল হক পারে। তবুও সে শাহিদার মতোই হারিয়ে যায়।

মায়ের সঙ্গে ইমামুল। সোমবার সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি

মায়ের সঙ্গে ইমামুল। সোমবার সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:০৪
Share: Save:

সে ছিল হারিয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট মেয়েকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। বজরঙ্গি-র হাত ধরে ছোট্ট শাহিদা ফিরে পেয়েছিল বাবা-মাকে। শাহিদা কথা বলতে পারত না। কিন্তু, ইমামুল হক পারে। তবুও সে শাহিদার মতোই হারিয়ে যায়। কয়েক জন কলেজ পড়ুয়ার চেষ্টায় এ রাজ্য থেকে বিহারে মা-বাবার কাছে ফিরল একরত্তি ছেলেটা।

বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতার মেটিয়াবুরুজের মাদ্রাসায় পাঠানো হয়েছিল ১২ বছরের ইমামুলকে। সেখানে মন বসেনি তার। বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাবে বলে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল মাদ্রাসা থেকে। স্টেশনে এসেও ভুল ট্রেনে উঠে বসে। সেই ট্রেন তাকে বসিরহাটে এনে ফেলে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ঠাঁই হয় বারাসতের এক হোমে।

সেই হোমের বাচ্চাদের জন্য প্রতি বছরই বড়দিনের উপহার দিতে যান এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। সেখানে ইমামুলের কান্না নজর কাড়ে তাঁদের। ইমামুলের সঙ্গে থাকা ছোট্ট পকেট ডায়েরির কয়েকটি ফোন নম্বর ধরে শুরু হয় খোঁজ। খুঁজে পেয়ে ইমামুলের বাবা-মাকে হোমে নিয়ে আসেন ওই তরুণ-তরুণীরাই। সোমবার বারাসতের হোম থেকে ইমামুলকে ফিরে পান মা-বাবা। তাঁদের জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইমামুল জানায়, ‘‘আমি গ্রামের স্কুলেই পড়ব।’’ মা-বাবাও কথা দেন, ছেলেকে আর বাইরে পড়াতে পাঠাবেন না।

বিহারের প্রত্যন্ত দুর্গাগঞ্জে বাড়ি ইমামুলদের। বাবা শেখ নাজমুল ও মা কাবিয়া খাতুন, দু’জনেই দিনমজুর। দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় ইমামুল। গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ত। প্রতিবেশির কাছ থেকে খোঁজ পেয়ে মাস তিনেক আগে মেটিয়াবুরুজের মাদ্রাসায় পাঠান মা-বাবা। মাদ্রাসার শিক্ষক মহম্মদ আদিল বলেন, ‘‘শুক্রবার নমাজের শেষে হারিয়ে যায় ইমামুল। খুঁজে না পেয়ে থানায় ও পরিবারকে জানাই।’’

এ দিন ইমামুল জানায়, বাড়ি ফেরার জন্য সে মেটিয়াবুরুজ থেকে ধর্মতলা হয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে চলে আসে। সেখান থেকে ভুল ট্রেন ধরে চলে যায় বসিরহাটে। সন্দেহ হওয়ায় যাত্রীরা তাকে তুলে দেয় রেল পুলিশের হাতে। পুলিশই ছেলেটিকে বারাসতের কিশলয় হোমে পাঠায়।

শনিবার হোমের বাচ্চাদের বড়দিনের উপহার দিতে যান ‘সচ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ২৫ জন কলেজ পড়ুয়া। অনাথ আশ্রম, হোম, স্টেশনের ভবঘুরে ছেলেমেয়েদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে, তাদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করেন তাঁরা। তাঁদেরই একজন, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সায়ন চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আমরা যখন ফিরছি, ইমামুলকে হোমে ঢোকানো হচ্ছিল। ও প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছিল।’’

ইমামুলের সঙ্গে কথা বলেন সায়নরা। জানতে পারেন, ছেলেটি বিহারের খাটিয়ার নামে একটি জায়গায় থাকে। ওর কাছে থাকা একটি ডায়েরি থেকে কয়েকটি ফোন নম্বরও মেলে। কিন্তু সব ক’টি নম্বরই সুইচ অফ পান সায়নেরা। হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী অদ্রিকা গুহ বলেন, ‘‘আমাদের জেদ চেপে যায়। ঠিক করি যে করেই হোক ওকে বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে।’’ সেই মতো ওই নম্বরগুলিতে বারবার ফোন করতে থাকেন অদ্রিকারা। রাতের দিকে একটি নম্বর বেজে ওঠে। যাঁর সঙ্গে কথা হয়, তিনি ইমামুলের সরাসরি আত্মীয় নন। তাঁর কাছ থেকে ইমামুলের পরিবারের খোঁজ মেলে। ওই ব্যক্তিকে ইমামুলের বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজি করান সায়নরা।

খবর পান ইমামুলের বাবা-মা। তাঁদের সঙ্গে সায়নদের সরাসরি ফোনে কথা হওয়ার পরে সোমবারেই কলকাতা আসেন তাঁরা। সেখান থেকে তাঁদের হোমে নিয়ে যান সায়নরাই। শিশু সুরক্ষা কমিটি (সিডব্লিউসি)-র মধ্যস্থতায় সরকারি নিয়ম মেনে কাগজপত্র তৈরি করে বাবা-মায়ের হাতে ইমামুলকে তুলে দেওয়া হয়।

বড়দিনের উপহার দিতে এসেছিলেন যে দাদা-দিদিরা, তাঁদের হাত ধরেই মা-বাবাকে ফিরে পেল ইমামুল। বড়দিনের এই মরসুমেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Emamul Hoque Bihar kolkata Metiabruz
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE