শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পরে কেটে গিয়েছে চার দিন। কিন্তু কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বর থেকে এখনও নড়েননি ইছাপুরের বাসিন্দা দম্পতি। তাঁরা চেয়েছিলেন, হয় ছেলের দেহ তাঁদের হাতে দেওয়া হোক, না-হলে সরকার ছেলের করোনা সংক্রমণের নথি দেখাক। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকে নিজেদের ১৮ বছরের ছেলে শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের দেহের ময়না-তদন্ত এবং শেষ বার দেখার অনুমতি আদায় করলেন ওই দম্পতি।
এ রাজ্যে এটিই সম্ভবত প্রথম ঘটনা, যেখানে করোনা-আক্রান্ত বা করোনার উপসর্গ থাকা কোনও রোগীর দেহের ময়না-তদন্ত হচ্ছে। দাহকাজের আগে পরিবারকে দেহ দেখার সুযোগ করে দেওয়ার ঘটনাও এটাই প্রথম। মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ওই নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশে বলা হয়েছে, শুভ্রজিতের দেহের ময়না-তদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি করতে হবে। তাঁর বাবা-মাকেও ছেলের দেহ দেখতে দিতে হবে। এমনকি, তাঁরা চাইলে ধর্মীয় আচারও পালন করতে পারেন। এই মামলার আইনজীবী ছিলেন বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা জানান, দেহের সৎকার-পর্বেরও ভিডিয়োগ্রাফির নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি। তবে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ’ (আইসিএমআর)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী শুভ্রজিতের দেহ কাউকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না।
গত বৃহস্পতিবার হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন ইছাপুর আনন্দমঠ হাইস্কুল থেকে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া শুভ্রজিৎ। শুক্রবার ভোরে ছেলেকে কামারহাটির ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর বাবা। অভিযোগ, ইএসআই হাসপাতাল থেকে তাঁদের পাঠানো হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নিয়ে তিন মিনিটের মধ্যে বাবার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে ফের ইএসআই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁদের। অভিযোগ, হাতে লেখা ওই চিরকুট দেখে আর চিকিৎসা করতে চায়নি ইএসআই হাসপাতাল। কারণ, তাতে লেখা ছিল, শুভ্রজিৎ ‘কোভিড ১৯ পজ়িটিভ।’
অভিযোগ, তার পরে হয়রানি আরও দীর্ঘায়িত হয় ওই দম্পতি ও তাঁদের ছেলের। ইএসআই হাসপাতাল থেকে তাঁদের পাঠানো হয় কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অভিযোগ, সেই চিরকুট দেখে ওই হাসপাতাল জানিয়ে দেয়, সেখানে কোভিড রোগীর শয্যা খালি নেই। তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। অভিযোগ, অ্যাম্বুল্যান্সেই ফেলে রাখা হয় শুভ্রজিৎকে। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা আত্মহত্যা করবেন বলায় শুরু হয় চিকিৎসা। শুক্রবার রাতেই মৃত্যু হয় শুভ্রজিতের। কিন্তু তাঁর দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, কোভিড রোগীর দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার নিয়ম নেই।
এ দিন ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি হয়। বিকাশরঞ্জনবাবু জানান, মামলার আবেদনে অভিযোগ করা হয়, কামারহাটির যে বেসরকারি হাসপাতালে শুভ্রজিতের কোভিড-সংক্রমণের পরীক্ষা হয়েছিল, সেখানকার ল্যাবরেটরি আইসিএমআর-এর অনুমোদনপ্রাপ্ত নয়। কেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ শুভ্রজিতের চিকিৎসায় গাফিলতি করল, কেনই বা ওই হাতে লেখা রিপোর্টকে গুরুত্ব দেওয়া হল, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে মামলায়।
জয়ন্তনারায়ণবাবু বলেন, “সরকার যদি ওই বেসরকারি হাসপাতালের রিপোর্টকেই মান্যতা দেয়, তা হলে শুভ্রজিতের বাবা-মায়ের লালারসের নমুনা পরীক্ষা হল না কেন? তাঁদের কোয়রান্টিনেই বা পাঠানো হল না কেন?” সরকার পক্ষের আইনজীবীরা ময়না-তদন্ত এবং পরিবারের হাতে দেহ তুলে দেওয়ায় আপত্তি জানান।
দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারপতি বসাক রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন, এ বিষয়ে আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা পেশ করতে হবে। তার পরের এক সপ্তাহের মধ্যে পাল্টা হলফনামা পেশ করতে হবে মামলার আবেদনকারীকে। পাঁচ সপ্তাহ পরে মামলাটির পরবর্তী শুনানি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy