Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Smuggling

পাচার নিয়ে এত বড় বড় কথা! আর কী হচ্ছে এ রাজ্যের সীমান্তে?

সিবিআই গোয়েন্দাদের জেরায় মুর্শিদাবাদের কুখ্যাত গরু পাচারকারী এনামুল জানিয়েছে, খালি ঘুষ দিতেই মাসে তার খরচ কমপক্ষে দশ কোটি টাকা। বিএসএফ, কাস্টমস থেকে শুরু করে পুলিশ বা বিভিন্ন মাপের রাজনৈতিক নেতা— সবাই আছে এই ঘুষের তালিকায়।

ভাইয়ের সঙ্গে সিবিআইয়ের হাতে ধৃত গরু পাচারকারী এনামুল হক (ডান দিকে)।

ভাইয়ের সঙ্গে সিবিআইয়ের হাতে ধৃত গরু পাচারকারী এনামুল হক (ডান দিকে)।

সিজার মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ১৪:৩৬
Share: Save:

একটা সময়ের জন্য ফাঁকা করে দেওয়া হয় সীমান্তের নির্দিষ্ট অংশের প্রহরা। সেই ফাঁকেই গলে যায় শয়ে শয়ে গরু। শুধুই কি গরু? মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্তে এনামুল শেখের পাচারচক্র ওপারে পাঠাত মাদক এবং নিষিদ্ধ কাফ সিরাপও। আর ওপার থেকে চলে আসত জাল নোট। এনামুল ধরা পড়ার পর সিবিআই জেরায় উঠে এসেছে ‘দেওয়া নেওয়া’র এক বিশাল চক্রের হদিশ। এই হাজার হাজার কোটি টাকার ‘কর্মকাণ্ডে’ রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে পুলিশ-সীমান্তরক্ষীদের একটা অংশ এক্কেবারে ‘ব্যবসায়িক’ হিসেবে জড়িত।

সিবিআই গোয়েন্দাদের জেরায় মুর্শিদাবাদের কুখ্যাত গরু পাচারকারী এনামুল জানিয়েছে, খালি ঘুষ দিতেই মাসে তার খরচ কমপক্ষে দশ কোটি টাকা। বিএসএফ, কাস্টমস থেকে শুরু করে পুলিশ বা বিভিন্ন মাপের রাজনৈতিক নেতা— সবাই আছে এই ঘুষের তালিকায়, জেরায় এমনটাই দাবি এনামুলের।

এ বছরের জানুয়ারি মাসে জিবু ডি ম্যাথিউ নামে এক বিএসএফ কমান্ডান্টকে কেরলে গ্রেফতার করে সিবিআই। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল বেহিসেবি প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা। মুর্শিদাবাদে কর্মরত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওই অফিসারকে জেরা করে জানা যায়, পুরো টাকাটাই এনামুলের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে পেয়েছিলেন ম্যাথিউ। এর পর মার্চে গ্রেফতার করা হয় এনামুলকে। তাকে ধরা হয়েছিল কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেল থেকে।

সিবিআই-এর পাশাপাশি, ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটেরও মাথাব্যথার কারণ ছিল এনামুল। তদন্তকারীদের দাবি, গরু সিন্ডিকেটের আড়ালে জাল নোট-মাদকের কারবার তো ছিলই, এনামুলের সঙ্গে জঙ্গি যোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। সেই দিক খতিয়ে দেখতে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে দিয়েছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি(এনআইএ)-ও।

দেখুন ভিডিও:

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের জেরাতেই প্রকাশ্যে এসেছে কী ভাবে মাত্র দু’বছরের মধ্যে মুর্শিদাবাদে নিজের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এনামুল। তার সম্পত্তির পরিমাণ দেখেও তাজ্জব হয়ে গেছেন আয়কর কর্তারা। কিন্তু কী ভাবে এই সাম্রাজ্য? কাদের সাহায্যে?

রঘুনাথগঞ্জের বাসিন্দা এনামুল এলাকার দুষ্কৃতী হিসেবে পরিচিত অনেক দিনই। মাদক পাচার-সহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে এনামুলের বিরুদ্ধে। কিন্তু কখনই এনামুল খুব বড় মাপের দুষ্কৃতী ছিল না, দাবি এক পুলিসকর্তার।

এক মঞ্চে গরু পাচারকারী ও পুলিশ কর্তা।

তিনি নিজে এক সময় মুর্শিদাবাদের পুলিস সুপার ছিলেন। তাঁর সময়েই একটি মাদক পাচারের মামলায় প্রায় এক বছর জেলে থাকার পর, পুলিশের তাড়ায় উত্তর ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরে গা ঢাকা দেয় এনামুল। জেরায় এনামুল জানিয়েছে, সংগ্রামপুরের এক তৃণমুল নেতার ভাই আব্দুল বারিক বিশ্বাস সেই সময় আশ্রয় দেয় তাকে। বারিকের হাত ধরেই সীমান্তে গরু পাচারে হাতেখড়ি এনামুলের। সিবিআই সূত্রে খবর, বারিকই তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেয় কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে, যাঁদের সাহায্যে জেলা পুলিশের শীর্ষ মহলে যাতায়াত শুরু করে এনামুল।

২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে গরু পাচার শুরু করে এনামুল। পাচার সিন্ডিকেটে তার নাম বিশু সেখ। এনামুল ঘনিষ্ঠ এক যুবকের কথায়— “শুরুর দিকে সূতী আর রঘুনাথগঞ্জ দিয়ে পাচার শুরু করে এনামুল। রাজস্থান, বিহার এবং উত্তর প্রদেশ থেকে গরু নিয়ে আসা হত। লরিতে করে প্রখমে পৌঁছত বীরভূমের ইলামবাজার এলাকায়। সেখান খেকে রঘুনাথগঞ্জে গ্রামের মধ্যে রাখা হত। পুরো ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হত জাতীয় সড়কের পাশে সোনার বাংলা হোটেল থেকে”। ওই যুবক দীর্ঘ দিন এনামুল ও তার দুই ভাই হুমায়ুন কবীর ওরফে পিন্টু শেখ এবং জাহাঙ্গির আলম ওরফে মন্টু শেখের সঙ্গে গরু পাচারের ব্যবসা করেছে।

এনামুলের ‘ব্যবসা’র বাড়বাড়ন্ত যে রাজ্য পুলিশের নজর এড়িয়ে গিয়েছে এমন নয়। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডি আই বি)-এর এক অফিসার এনামুল সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট (১০৪৬ টিসি/ ১৮-০২-১৬)পাঠান তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। সেই রিপোর্টে ওই অফিসার এনামুল ও তার পাচার সিন্ডিকেটের সদস্যদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন জানিয়েছেন, তেমনি উল্লেখ করেছেন কী ভাবে গরু পাচারের আড়ালে এনামুলের সিন্ডিকেট বাংলাদেশ থেকে জাল নোট আমদানি করছে। অন্য দিকে এ দেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে মাদক ও নিষিদ্ধ কাফ সিরাপ। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল— সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে পাচারকারীদের আঁতাতের কথা। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এনামুলের ঘনিষ্ঠতার বিষয়েও বলা হয়েছে এই রিপোর্টে। কিন্তু তার পরও এনামুলের টিকি ছোঁয়া দূরে থাক, পরবর্তী সময়ে রমরমিয়ে বেড়েছে এনামুলের ব্যবসা। পুলিস প্রশাসন ও শাসক দলের অন্দরে তার দাপট এতটাই বেশি ছিল যে, জেলার খোদ মন্ত্রী জাকির হোসেন রঘুনাথগঞ্জ থানায় এনামুলের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগে এফ আই আর (৭৫৬/১৭) করলে, পুলিশ এনামুলকে ধরা দূরে থাক, মন্ত্রীকেই ধমক শুনতে হয়েছিল দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। মন্ত্রীকে এনামুলের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “আমি এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।” তার পর বলেন, “আইন আইনের পথে চলবে”।

সিবিআই-এর কাছে জেরায় এনামুলের দাবি, প্রথম দিকে এক জোড়া গরু সীমান্তপার করতে তার সিন্ডিকেট নিত ৩২ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার টাকা প্রতি জোড়া। এনামুলের সঙ্গেই জেরা করা হয় ধৃত বিএসএফ কমান্ডান্ট জিবু ম্যাথিউকে। সে জেরায় স্বীকার করে, মাসে ৪০ লাখ টাকার পাশাপাশি, পাচার হওয়া প্রতিটি গরুর জন্য ৫ হাজার টাকা পেত বিএসএফ-এর সীমান্ত চৌকি। নিয়ম খুব সোজা। কয়েক ঘণ্টার জন্য ফাঁকা করে দেওয়া হত সীমান্তের নির্দিষ্ট এলাকা। সিন্ডিকেটের স্থানীয় ভাষায় এর নাম লাইন খোলা। সিবিআই তদন্তকারীরা এনামুলকে টানা জেরা করার পর এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওপার বাংলার জামাত জঙ্গিদের যোগের সম্ভবনা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। এনামুলের সিন্ডিকেটের মাদক, জালনোট ও অস্ত্র পাচারের কথা তাদের কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করেছে সিবিআই। সেই তথ্য দেখে রীতিমত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেরল হাইকোর্টের বিচারপতি বি সুধীন্দ্র কুমার। তিনি জিবুর করা জামিনের আর্জি খারিজ করে দিয়ে এনআইএ তদন্তের সুপারিশ করেন। “সিবিআই এখনও পর্যন্ত তদন্ত করার পর, তাঁদের জোরাল সন্দেহ, ধৃত এনামুল ওরফে বিশু শেখ জঙ্গিদের হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা আনতে সাহায্য করেছে। সেই সঙ্গে অস্ত্র পাচারেও যোগ আছে ধৃতের। তদন্তে ইতিমধ্যেই জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসছে। তাই এনআইএ-কে দিয়ে এই ঘটনার বিস্তৃত তদন্ত করা প্রয়োজন”— বলেন বিচারপতি বি সুধীন্দ্র কুমার।

সিবিআই তাদের তদন্ত রিপোর্ট ইতিমধ্যেই জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা ও এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং আয়কর দফতরকে পাঠিয়েছে। আয়কর দফতর কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের একাধিক জায়গায় হানা দেয়। এনামুলের সম্পত্তির প্রাথমিক যে তালিকা তৈরি করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে চালকল, লোহা কারখানা, একটি নামি মার্বেল কোম্পানির একাধিক শোরুম, কলকাতা ও বহরমপুর মিলিয়ে অন্তত ১০টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট। তা ছাড়াও আছে ২৫টি ট্রাক, জাতীয় সড়কের ওপর প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমি। “কয়েকশ কোটি টাকার সম্পত্তির হদিশ পেয়েছি আমরা। আমরা ইডিকেও জানিয়ে‌ছি”— বলেন এক আয়কর কর্তা। তাঁদের সন্দেহ, বাংলাদেশেও বেনামে বহু সম্পত্তি কিনেছে এনামুল এবং এনামুলের সিন্ডিকেটে বারিক বিশ্বাসের টাকাও রয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি, এনামুলকে দিয়েই এ রাজ্যের একাধিক রাঘব বোয়াল পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে, যাদের মদতেই এই সীমান্ত চোরাচালানের বাড়বাড়ন্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Crime Smuggling Cattle Smuggling Drug Trafficking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE