Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কীসের ব্যথা বন্দিনীর, তল পাচ্ছে না সিবিআই

রাজার অসুখ নয়। বলা চলে, ‘রানি’র অসুখ। ‘বন্দি রানি’র বুকে ব্যথা! কেন ব্যথা? কীসের ব্যথা? জবাব খুঁজতে গিয়ে তদন্ত মাথায় উঠে গিয়েছে সিবিআইয়ের। ওই ‘হাই-প্রোফাইল বন্দিনী’ দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন বেসরকারি হাসপাতালের ঝকঝকে কেবিনে। অসুখ সারার লক্ষণ নেই। অথচ অসুখটা যে ঠিক কী, তা-ও পুরোপুরি মাথায় ঢুকছে না তদন্তকারীদের।

মনোরঞ্জনা সিংহ

মনোরঞ্জনা সিংহ

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

রাজার অসুখ নয়। বলা চলে, ‘রানি’র অসুখ। ‘বন্দি রানি’র বুকে ব্যথা! কেন ব্যথা? কীসের ব্যথা?

জবাব খুঁজতে গিয়ে তদন্ত মাথায় উঠে গিয়েছে সিবিআইয়ের। ওই ‘হাই-প্রোফাইল বন্দিনী’ দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে রয়েছেন বেসরকারি হাসপাতালের ঝকঝকে কেবিনে। অসুখ সারার লক্ষণ নেই। অথচ অসুখটা যে ঠিক কী, তা-ও পুরোপুরি মাথায় ঢুকছে না তদন্তকারীদের।

অগত্যা ডাক্তারি রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে হাপিত্যেশ অপেক্ষায় রয়েছে সিবিআই। ডাক্তারদের অনুমতি নিতে হচ্ছে পদে পদে। জেরা তো দূরের কথা, চিকিৎসকদের অনুমতি ছাড়া বন্দিনীর সঙ্গে দেখা করারও জো নেই কারও। সারদা গোষ্ঠীর আর্থিক কেলেঙ্কারিতে মনোরঞ্জনা সিংহকে গ্রেফতারের কয়েক দিন পর থেকেই তদন্তকারীদের এই ভোগান্তি চলছে।

ঠিক কী হয়েছে মনোরঞ্জনার?

সিবিআইয়ের কাছে সেটা লক্ষ লক্ষ টাকার প্রশ্ন তো বটেই। এমনকী হাসপাতালের ডাক্তারেরাও ওই রোগিণীর রোগ খুঁজতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছেন। গোড়ায় বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মনোরঞ্জনা। মাথাও ঘুরছিল। হাসপাতাল সূত্রের খবর, নানা রকম পরীক্ষা করিয়েও তাঁর শরীরে জটিল কোনও রোগের হদিস মেলেনি। হৃদ্‌যন্ত্র ও ফুসফুস সতেজ। অতীতেও কোনও জটিল রোগের রেকর্ড নেই তাঁর। কিন্তু বুক ধড়ফড় যদি বা কমে, রোগিণী কাবু হয়ে পড়েন কোমরের ব্যথায়! কিংবা হয়তো চোখে অন্ধকার দেখছেন। কখনও-সখনও রক্তচাপের ঈষৎ ওঠানামারও আভাস মিলেছে। তবে বড়সড় অসুখের প্রমাণ মেলেনি।

হাসপাতাল সূত্রের খবর, গোড়ালি ও কোমরের সিটি স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে, রিপোর্ট মোটের উপরে ভাল। সামান্য চোট ধরা পড়েছে। পায়ে কেন ব্যথা হচ্ছে, তা খুঁজতে গিয়ে ডাক্তারদের অনুমান, ‘‘মনে হচ্ছে, সারা ক্ষণ এক ভাবে শুয়ে থাকার ফলেই পা ধরে গিয়েছে ওঁর। গোড়ালির পেশি ও শিরায় রক্ত চলাচল কম হচ্ছে।’’ তাই কেবিনের ভিতরে-বাইরেই সকাল-সন্ধে নিয়ম করে খানিক হাঁটানো হচ্ছে রোগিণীকে। তাতেই কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। রক্তচাপেও স্থিতিশীলতা এসেছে। তবু এখনই মনোরঞ্জনাকে ছাড়া যাচ্ছে না বলে জানান হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। কেন? ‘‘ওঁর কোনও না কোনও সমস্যা লেগেই আছে। একটি সারলে আর একটির উদয় হচ্ছে,’’ বললেন এক ডাক্তার।

বন্দি রানির এই রোগের প্রকোপ দেখে বন্দি এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তদন্তকারীদের। তিনি মদন মিত্র। অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে রাজ্যে শাসক দলের ওই প্রাক্তন মন্ত্রী সারদা মামলায় গ্রেফতার হয়েও লাগাতার হাসপাতালে থাকছিলেন। এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডের কেবিনটাই মদনবাবুর খাসতালুক হয়ে উঠেছিল। এক বার জামিনে মুক্তি পেয়েই হাসপাতাল থেকে পত্রপাঠ ‘ডিসচার্জ’ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন তিনি। সেই জামিন নাকচ হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য নিয়মিত জেলেই থাকছেন মদনবাবু। আর মনোরঞ্জনার ক্ষেত্রে একটানা হাসপাতালের কেবিনই যেন ঘরবাড়ি।

অসমে ‘ফ্রন্টিয়ার’ নামে একটি নিউজ চ্যানেল ও ‘রাজধানী’ নামে একটি খবরের কাগজ চালু করার জন্য সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে ৪২ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে মনোরঞ্জনার বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগেই গত ৭ অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই। এবং বিপত্তির শুরু তার পর থেকেই। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা অসমের কংগ্রেস নেতা মাতঙ্গ সিংহের প্রাক্তন স্ত্রী, ৪৮ বছরের মনোরঞ্জনার নিত্যনতুন আর্জি-আবদারে তদন্তকারীরাই বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন। গোড়ায় সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই হেফাজতে দিনভর জেরা করার পরে রাতে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানায় তাঁকে রাখার ব্যবস্থা হয়। গরমে ঘুম আসত না বন্দিনীর। তিনি বলেন, লক-আপে ‘এসি’ বসাতে হবে। তার কয়েক দিন পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন বলে সিবিআই সূত্রের খবর।

গত ১২ অক্টোবর থেকে কিছু দিনের জন্য মনোরঞ্জনার ঠিকানা ছিল এসএসকেএম হাসপাতাল। কিন্তু সেখানকার ব্যবস্থাও পছন্দ হয়নি ওই বন্দিনীর। সেখানে আলাদা চানঘর-শৌচাগারের সুবিধা না-থাকায় তাঁর বেজায় অসুবিধে হচ্ছে বলে জানান মনোরঞ্জনা। তার কিছু দিন বাদে সিবিআই হেফাজত থেকে বন্দিনীকে জেল-হাজতে পাঠানোর আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক। কিন্তু মনোরঞ্জনা তত দিনে কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে উন্নততর চিকিৎসার জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছেন। সেই আর্জির ভিত্তিতে এসএসকেএম থেকে তাঁর ঠাঁই হয় একবালপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। গত ১১ নভেম্বর থেকে সেখানেই রয়েছেন তিনি। কেবিন নম্বর ৭০৪। খাতায়-কলমে জেলবন্দি হলেও এখনও পর্যন্ত একটি দিনও শ্রীঘরে কাটাতে হয়নি অভিজাত, সম্পন্ন ঘরের ওই মহিলাকে। মাসের পর মাস হাসপাতাল-বাসে জলের মতো টাকা খরচ হচ্ছে। ‘হাই-প্রোফাইল’ কয়েদি নিজেই চিকিৎসার ভার বহন করছেন।

ভারটা কী রকম?

হাসপাতাল সূত্রের খবর, মনোরঞ্জনা যে-কেবিনে রয়েছেন, তার রোজকার ভাড়া ১৪ হাজার টাকা। শুধু কেবিন ভাড়া বাবদই প্রায় ছ’লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। এ ছাড়া নানান শারীরিক পরীক্ষানিরীক্ষা মিলিয়ে আরও কয়েক লক্ষ। সব মিলিয়ে হাসপাতালে ১০ লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেলেও মনোরঞ্জনার কোনও তাপ-উত্তাপ চোখে পড়েনি বলেই জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা। মনোরঞ্জনার ছেলেকে নিয়ে তাঁর দুই ভাই আর বোনও পড়ে আছেন কলকাতায়। আলিপুরে একটি অতিথিশালা ভাড়া নিয়ে তাঁরা সপরিবার ঘাঁটি গেড়েছেন।

মনোরঞ্জনা হাসপাতালে তোফা আছেন। তাঁর পরিবারও দিব্যি আছেন অতিথিশালায়। কিন্তু তদন্তকারীরা যে বড় চিন্তায় আছেন! এই অবস্থায় ওই বন্দিনীকে ঠিকঠাক জেরা করা যাবে কী ভাবে, তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় সিবিআই। ‘‘৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মনোরঞ্জনাদেবীর চিকিৎসার সব নথি সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভিমত নেওয়া হচ্ছে। সব তথ্য আদালতে জমা দেওয়া হবে। তার পরে কী হয়, দেখা যাক,’’ অনিশ্চিত শোনাল তদন্তকারী দলের নেতৃত্বে থাকা এক সিবিআই-কর্তার গলা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

manoranjana singh cbi saradha scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE