Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাঘরোল বাঁচাতে ভরসা ‘খুদে বিজ্ঞানী’র দল

বাঘরোল বা মেছো বিড়াল হল পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্য প্রাণী’। সোমনাথেরা সগর্বে বলে, ‘‘আমরা বাঘরোল রক্ষক।’’

বাঘরোল।

বাঘরোল।

ঋজু বসু
উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৮ ০৪:১৯
Share: Save:

নিশুত রাতের বন্ধু! জলার ধারে হোগলাবন, ঘন খড়িঘাস বা মন্টু ঘোষেদের তিন পুরুষের পুকুরঘাটে তার অপেক্ষায় ঠায় রাত জাগে দু’‌জোড়া যান্ত্রিক চোখ।

সেই ক্যামেরা-চোখের মণিতেই বন্দি রোজ রাতের ডোরাকাটা দাপাদাপি। ঝুঁকে পড়ে সেই ‘বন্ধু’র নৈশ অভিযান দেখতে দেখতে পাড়াগেঁয়ে শৈশবের বিস্ময়-ভরা ডাগর চোখগুলোও জ্বলজ্বল করে। মহেশপুর, বাগনান, উলুবেড়িয়ার হাইস্কুলের ক্লাস নাইন, সিক্স, সেভেনের পৃথা, সুরজিৎ, গুরুপদেরা পুকুরপাড়ে বসানো ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে ভাবে, ‘‘ওই বাঘরোল দু’‌টোই কি আগেও আসত!’’

দলের পান্ডা সোমনাথ ঘোষ। কইজুরি হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণি। গম্ভীর মুখে বলল, ‘‘পরপর কয়েক রাত ওদের পিঠের দাগটা আমি লক্ষ করেছিলাম। ওরা মনে হয় দুই বোন! নাম রেখেছি, রুমকি আর ঝুমকি।’’ এ রাজ্যের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো প্রাণী সংরক্ষণবিদ তিয়াসা আঢ্য, সোমনাথের ‘তিয়াসাদি’ আদর করে তাকে ডাকেন ‘লোকাল সায়েন্টিস্ট’। মুম্বই রোড ধরে গাড়িতে আধ ঘণ্টাটাক, কলকাতার গা ঘেঁষা উলুবেড়িয়া-১ ব্লকের মহেশপুর গ্রামে ঢুকতেই খুদে বিজ্ঞানী হাত ধরে টানতে থাকে। মেঠো ইঁদুরের গর্ত, ডাহুক পাখির ছানা কিংবা গ্রামের অমল ঘোষের বাড়ির পিছনে খড়িবনে ‘বাঘরোল বাবাজি’র বাড়ি বা পায়ের ছাপ দেখতে তখনই যেতে হবে!

কয়েক মাস আগে এ গ্রামে ঢুকে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে তথ্যচিত্রের পরিচালক আকাঙ্ক্ষা সুদ সিংহের। বাঘরোল বা মেছো বিড়াল হল পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্য প্রাণী’। সোমনাথেরা সগর্বে বলে, ‘‘আমরা বাঘরোল রক্ষক।’’ বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বাঁচাতে বিখ্যাত টিভি ধারাবাহিক ‘অন দ্য ব্রিঙ্ক’-এ পশ্চিমবঙ্গের বাঘরোল নিয়ে পর্বটিতে উঠে আসছে সোমনাথদের গল্প। বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যাবে রুমকি-ঝুমকিদের প্রতি বাংলার এই খুদেদের ভালবাসার কথা। আজ, সোমবার, ২৭ অগস্ট অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে তা দেখানোর কথা। পরে ডিসকভারি চ্যানেলেও ছবিটি দেখানো হবে।

নজরদারি: ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পরীক্ষা করছে খুদেরা। উলুবেড়িয়ার মহেশপুর গ্রামে। ছবি: সুব্রত জানা।

সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজে বাঘরোলের হাঁড়ির খবর নিতে সোমনাথদের গ্রাম মহেশপুরের ঘোষপাড়াতেও ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ বসিয়েছেন তিয়াসারা। সোমনাথেরা শিখে নিয়েছে ক্যামেরায় নজরদারির কাজ। শীতের আগে ঘন খড়িঘাসের বন কেটে ফেলার আগে নিয়মিত আসত রুমকি-ঝুমকি। হঠাৎ তাদের দেখা নেই! সোমনাথ বলে, ‘‘খুব ভয় করছিল, কেউ মেরে ফেলেনি তো! দেড় মাস বাদে দেখি, আবার ওরা ফিরে এসেছে।’’ গ্রামীণ বালকের চোখে একশো জোনাকির আলো!

লোকালয়ের গাঁ ঘেষে থাকা বাঘরোলদের ভবিষ্যৎ যে ‘গ্রামের আগামীর মুখদের’ সঙ্গেই জড়িয়ে, তাতে দ্বিমত নেই আকাঙ্ক্ষা-তিয়াসার। পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে আসা এক দল খেতমজুরের বাঘরোল শিকারের চেষ্টা ওরা রুখে দিয়েছে সদ্য। মাছ, মুরগি, ছাগললোভী বাঘরোলকে শত্রু মনে করেন অনেক গ্রামবাসীই। তাই সোমনাথেরা বড়দের বোঝায়, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর! গড়গড়িয়ে বলতে থাকে, ‘‘বাঘরোল কিন্তু ফসলের শত্রু ইঁদুরকেও খেয়ে ফেলে। রাজ্য প্রাণী বলে কথা! ওদের জন্য গ্রামের মাথা কত উঁচু হয়েছে।’’

বাঘরোলকে ঘটা করে রাজ্য প্রাণীর তকমা দেওয়া হলেও তাদের রক্ষা করার জন্য কোনও নীতি তৈরি হয়নি বাংলায়। তাই গ্রামবাসীদের ভিতরকার বাঘরোল রক্ষকেরাই ভরসা, মনে করেন তিয়াসারা।

মহেশপুরের খুদে-বাহিনী অভয় দেয়, ‘‘আমরা আছি! এ গ্রামে ওদের ভয় নেই।’’ এক পশলা বৃষ্টি শেষে বাঘরোলের বাড়ির ঘাসবনে তখন সবুজ, করুণ ছায়া! প্রত্যয়ের সুর বলে, মানুষে-প্রাণীতে মিলে বেঁচে থাকা সম্ভব একে অন্যের বন্ধু হয়ে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Civet Cat Camera Trap Scientist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE