Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সমাবেশ নিয়ে প্রকাশ্যেই টক্কর দিলীপ-কৈলাসে

যা দেখে বিরোধীরা তো বটেই, রাজনৈতিক মহলের একাংশেরও ব্যাখ্যা, বিজেপিতে এত দিন যা হত রেখে-ঢেকে, এ দিন সেই দিলীপ-কৈলাস ‘টক্কর’ একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

স্যমন্তক ঘোষ ও নমিতেশ ঘোষ
কোচবিহার শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৬
Share: Save:

বিভ্রান্তি ছিলই। শুক্রবার দিনভর দৃশ্যত তা আরও প্রকট হল। দেখা গেল সমন্বয়ের অভাব। যা দেখে বিরোধীরা তো বটেই, রাজনৈতিক মহলের একাংশেরও ব্যাখ্যা, বিজেপিতে এত দিন যা হত রেখে-ঢেকে, এ দিন সেই দিলীপ-কৈলাস ‘টক্কর’ একেবারে প্রকাশ্যে চলে এল।

বৃহস্পতিবারই রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, শুক্রবার তিনি সভা করবেন। দলের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেছিলেন, আদালতকে অমান্য করে সভা হবে না। এ দিন কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের নতুন রায় এসেছে বিকেলে। তার আগে পর্যন্ত দৃশ্যতই বিভ্রান্ত ছিল দলের দুই শিবির।

টেস্ট ম্যাচের নাইট ওয়াচম্যানের মতো, এ দিন সকাল থেকেই হোটেলের লবিতে বসে সময় ‘কিনছিলেন’ কৈলাস-সহ দলের একাধিক নেতা। চোখ ছিল টেলিভিশনের পর্দায়। দেখছিলেন, এক, আদালতের রায় কোন দিকে যায়। দুই, দিল্লিতে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ সাংবাদিক সম্মেলন করে কী বার্তা দেন। তারই মধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর। সমাবেশ কি হবে? বহু বার এই প্রশ্নের উত্তরে কৈলাস এবং বাকি নেতাদের একটিই উত্তর ফিরে ফিরে আসছিল, ‘‘আদালতকে অমান্য করে সভা-সমাবেশ হবে না। বিজেপি গণতান্ত্রিক দল, আদালতকে সম্মান করে।’’

অন্য দিকের ছবিটি তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্য হোটেলে ওঠা দিলীপবাবু সকাল থেকেই সভার ‘টেম্পো’ ধরে রাখছিলেন। কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন, সমাবেশের কাজে যেন ‘ঢিলে’ না পড়ে। দিল্লিতে শাহের সাংবাদিক বৈঠক শেষ হওয়ার পরেই তিনি রওনা হন মদনমোহন মন্দিরের উদ্দেশে। জানিয়ে দেন, সেখান থেকেই সভায় যাবেন। এ বিষয়ে কৈলাস শিবিরকে প্রশ্ন করা হলে ফের জানিয়ে দেওয়া হয়, সভা নয়, দিলীপবাবু কর্মীদের ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছেন।

শাহের সমাবেশ ঘিরে যে জনসমাগমের চিত্র তৈরি করেছিল বিজেপি, এ দিন সভাস্থলে তত মানুষ দেখা না গেলেও ভিড় কম হয়নি। এক সময়ে জাতীয় সড়কের দিকের কাপড় সরিয়ে দেন সভাস্থলে হাজির দলীয় কর্মীরা। তখন ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কে ভিড় জমে যায়। ব্যাহত হয় যান চলাচল। অভিযোগ, এলাকায় বিশেষ পুলিশও দেখা যায়নি। এর পরে দিলীপবাবুর উপস্থিতিতেই একের পর এক রাজনৈতিক বক্তৃতা শুরু করেন রাজ্যের যুব সভাপতি দেবজিৎ সরকার-সহ বহু নেতা। বিজেপিতে যাঁরা দিলীপ ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। দিলীপও ওঠেন বক্তৃতা করতে।

প্রায় তার কাছাকাছি সময়েই হোটেলের কনফারেন্স রুমে সাংবাদিক বৈঠক ডাকেন কৈলাস। শাহের সুরেই রাজ্য প্রশাসন এবং সরকারের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ অভিযোগ আনেন এবং জানান, আদালত অনুমতি দিলে রথযাত্রা হবে। অমিত শাহও রাজ্যে আসবেন। তাঁর নেতৃত্বেই রথের কর্মসূচি পালিত হবে। কিন্তু দিলীপবাবু তো সভাস্থলে পৌঁছে গিয়েছেন? কৈলাস পুরনো বক্তব্যেই স্থির থাকেন, ‘‘ওখানে নেতারা জনগণকে ধন্যবাদ দিতে গিয়েছেন, সভা করতে নয়।’’

ইতিমধ্যেই বক্তৃতা শুরু করেছেন দিলীপবাবু। সভায় পৌঁছেছেন দলের কেন্দ্রীয় সহ-পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন। জাতীয় দলে তাঁর সঙ্গে কৈলাসের ‘মধুর’ সম্পর্ক বহু চর্চিত। দু’জনে সহমতে পৌঁছন, এমন ‘অভিযোগ’ শোনা যায় না। বক্তৃতার শুরুতেই দিলীপবাবু প্রথম বারের জন্য বলেন, ‘‘সভা নয়, সকলকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় কর্মীদের গাড়ি আটকেছে। তবুও এত লোক এসেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ।’’ এর পরেই তিনি ঢুকে পড়েন রাজনৈতিক বক্তব্যে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে শুরু করে জঙ্গলমহলে ‘অনাহার’-এ মৃত্যু, ছুঁয়ে যান সমস্ত কিছুই। তবে তাঁর বক্তৃতা ছিল সংক্ষিপ্ত। সভার শেষে সাংবাদিকদেরও তিনি বলেন, ‘‘আদালতের উপর ভরসা আছে। আদালত অবমাননা করতে চাইনি। কিন্তু আমায় আসতেই হত। যাঁরা এসেছেন, তাঁরা আমার আহ্বানেই এসেছেন।’’ কিন্তু তিনি যা বললেন, তা তো রাজনৈতিক বক্তৃতাই! দিলীপবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এই সভায় যাঁদের আসার কথা ছিল, তাঁরা আসেননি। ফলে এটা রথের সভা নয়।’’ সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডায় অরবিন্দের ঠাট্টা, ‘‘একে সভা বলাও যায়, আবার না-ও বলা যায়। এটা যাত্রার সূচনামাত্র।’’ কিন্তু কৈলাসরা কেন এলেন না সভায়?

বিকেলে সভার লোক যখন ঘরের পথে, তখন জাতীয় সড়কে আটকে কৈলাসদের গাড়ি। ভিড় ভেঙে ছড়িয়ে গোটা রাস্তা তখন বিজেপি সমর্থকদের দখলে। কোথায় যাচ্ছেন? ‘‘সভার কর্মীদের ধন্যবাদ দিতে যাচ্ছিলাম,’’ বলেন কৈলাস। দিলীপবাবুর গাড়ি তত ক্ষণে উল্টোপথে। আদালতের রায় কোন দিকে যাচ্ছে, তা-ও তত ক্ষণে খানিক স্পষ্ট। যা নিয়ে এর পর আবার বৈঠকে বসবেন সকলে এবং বেরিয়ে এসে দিলীপবাবু বলবেন, ‘‘১৪ তারিখ রথের কর্মসূচি যাতে পালন করা যায়, সেই চেষ্টা করব। ১৬ তারিখ প্রধানমন্ত্রীরই তো আসার কথা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত কলকাতায় গিয়ে ঠিক করব।’’

তৃণমূলের কোচবিহার জেলার সভাপতি ও রাজ্যের মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের টিপ্পনি, ‘‘এদের নিজেদের মধ্যেই বোঝাপড়া নেই। তাই মানুষ এদের সঙ্গে নেই। আজ তা প্রমাণিত।’’ রাতে বিধি ভেঙে সভা করার অভিযোগে কোচবিহার কোতোয়ালি থানায় দিলীপ ঘোষ, কৈলাস বিজয়বর্গীয় ও রাহুল সিংহ-সহ বিজেপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dilip Ghosh Kailash Vijayvargiya Conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE