Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ক্যাঁচক্যাঁচ-হিসহিস, আড়ি পাতে কে!

বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন এমন অভিযোগ তুলতেন হামেশাই। কিন্তু এখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর হাতে। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখনও ধারণা যে, কেউ বা কারা তাঁর টেলিফোনে আড়ি পাতছে। আর তার জেরেই থরহরিকম্প রাজ্য প্রশাসনের অন্দরমহল।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন এমন অভিযোগ তুলতেন হামেশাই। কিন্তু এখন তিনি মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী তাঁর হাতে। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এখনও ধারণা যে, কেউ বা কারা তাঁর টেলিফোনে আড়ি পাতছে। আর তার জেরেই থরহরিকম্প রাজ্য প্রশাসনের অন্দরমহল।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, তাঁর ফোনে যে আড়ি পাতা হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, ফলে যে কোনও মূল্যে তা পালন করতে হবে। কিন্তু উপায় কী? শেষ পর্যন্ত ভেবেচিন্তে উপায় একটা বের করেছেন নবান্নের কর্তারা। স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে অত্যন্ত গোপনীয় একটি চিঠি লিখে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে কি না, তা জানার কথা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিফোন সংস্থাগুলির। তাই প্রতি মাসের পয়লা তারিখে টেলিফোন সংস্থাগুলিকেই ঘোষণা করতে হবে যে, মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরটিতে আড়ি পাতা হয়নি। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনারের টেলিফোনেও যে আড়ি পাতা হচ্ছে না, তা-ও টেলিফোন সংস্থাগুলিকে প্রতি মাসে হলফনামা দিয়ে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব। লালবাজার সূত্রের খবর, নবান্নের নির্দেশ পাওয়ার পর পুলিশ কমিশনার টেলিফোন সংস্থাগুলির থেকে লিখিত ঘোষণাপত্র আদায় করা শুরু করেছেন। গত কয়েক মাস ধরেই এই ব্যবস্থা চলছে। মুখ্যমন্ত্রীকেও পুলিশ এ কথা জানিয়েছে। এমনকী, এর মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইল নম্বর পরিবর্তন হওয়ায় পুলিশ কমিশনার সেই নম্বরও টেলিফোন সংস্থাকে জানিয়ে দিয়েছেন বলে কলকাতা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

কিন্তু এই কাণ্ডের পিছনের ঘটনাটা ঠিক কী? মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রের খবর, কয়েক মাস আগে মুখ্যমন্ত্রী মোবাইলে কথা বললেই তাঁর ফোন বার বার কেটে যাচ্ছিল। কথার মাঝে ‘হিসহিস’ বা ‘ক্যাঁচক্যাঁচ’ আওয়াজও হচ্ছিল। তাতেই মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়, তাঁর মোবাইলে কেউ আড়ি পাতছে। তিনি মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশ প্রধানকে ডেকে বলেন, তিনি নিশ্চিত যে তাঁর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে। এবং অবিলম্বে তিনি এর বিহিত চান। মমতার মুখে এ কথা শুনে চমকে ওঠেন নবান্নের কর্তারা। তাঁরা বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, এমন ঘটনার কথা তাঁদের জানা নেই। কিন্তু মমতা কোনও যুক্তিই মানতে চাননি। বরং তিনি আমলাদের জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সংস্থা তাঁর ফোনে বেআইনি ভাবে আড়ি পাততেই পারে। ফলে ব্যবস্থা নিতেই হবে।

এর পরই পুলিশ কমিশনারকে চিঠি লিখে স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘১৯৫১ সালের ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ রুলস-এর ৪১৯এ ধারা অনুযায়ী রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবেরই একমাত্র আইনসিদ্ধ আড়ি পাতার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে তা দেওয়াও হয়। কিন্তু এই আইনগত অবস্থান থাকা সত্ত্বেও কোনও বহিরাগত সংস্থা দ্বারা বেআইনি ভাবে আড়িপাতার ঘটনা অসম্ভব নয়। নিরাপত্তার খাতিরে এমন কিছু ঘটছে কি না, তা জানা প্রয়োজন। রাজ্যের কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তার প্রশ্নেই ১৮৮৫-র টেলিগ্রাফ আইন এবং ১৯৭২ সালে ওই আইনের যে সংশোধনী হয়েছে তার ৫ নম্বর ধারা মোতাবেক বেআইনি আড়ি পাতার ঘটনার উপর নজরদারি প্রয়োজন।’

স্বরাষ্ট্রসচিবের চিঠিতে এর পরেই পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে,‘মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব,ডিজি এবং কলকাতার পুলিশ কমিশনারের মোবাইল ফোনে যে বেআইনি আড়ি পাতার ঘটনা ঘটেনি, তা প্রতি মাসের পয়লা তারিখে টেলিফোন সংস্থাগুলিকে কনফার্মেশন রিপোর্ট দিয়ে বলতে হবে। পুলিশ কমিশনারের কাজ হবে এই পাঁচ জনের নম্বর টেলিফোন সংস্থার কাছে সময়ে সময়ে পৌঁছে দেওয়া।’

কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানান, নবান্নের নির্দেশ আসার পর টেলিফোন সংস্থাগুলির কাছ থেকে লিখিত রিপোর্ট নেওয়া হচ্ছে। তবে মুখ্যমন্ত্রী-সহ শীর্ষকর্তাদের ফোনে আইনি বা বেআইনি ভাবে আড়ি পাতা হচ্ছে, এমন খবর নেই। পুলি‌শ সূত্রের খবর, যে পাঁচটি নম্বর সম্পর্কে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে তার সব ক’টিই দু’টি বেসরকারি সংস্থার। তাদের মুখপাত্ররা অবশ্য এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘আইনসিদ্ধ আড়ি পাতার ক্ষেত্রে সরকারি আদেশ মেনে চলা হয়।’’

স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, রাজ্য ও কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী, এসটিএফ, সিআইডি, সাইবার ক্রাইম বিভাগ সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩০-৩৫ হাজার টেলিফোনে আড়ি পাতে। ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট অনুসারে এক টানা সাত দিনের বেশি কোনও ফোনে আড়ি পাততে গেলে স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমতি নিতে হয়। ওই টেলিফোনগুলিতে সেই নিয়ম মেনেই আড়ি পাতা হয়। ওই কর্তা বলেন,‘‘মাওবাদী উপদ্রব চলাকালীন জঙ্গলমহলের প্রায় সব ফোনেই আড়ি পাতা হতো। ইদানীং সেই পরিস্থিতি নেই। কিন্তু আড়ি পাতার বহর কমেনি। এখন মাওবাদী এলাকার বাইরেও বহু সংখ্যক ফোনে আইনসিদ্ধ ভাবে আড়ি পাতা হয়।’’

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী যে বেআইনি আড়িপাতার কথা বলেছেন, তা কি এই রাজ্যের পুলিশ বা গোয়েন্দাবাহিনী করে না? নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, বেআইনি ভাবে কোনও ফোনে আড়ি পাতা হয় না। যদিও গোয়েন্দা বিভাগ থেকে অবসর নেওয়া এক পুলিশ কর্তা জানিয়েছেন, তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশকে সবই করতে হয়। নির্দিষ্ট খবর জোগাড় বা কারও উপর নজরদারি চালাতে হলেও পুলিশ বেআইনি ভাবে আড়ি পাতে।

কী ভাবে সেই কাজ করা হয়?

ওই গোয়েন্দা কর্তা জানিয়েছেন, টেলিফোন সংস্থার থেকে যাঁর উপর নজরদারি চালানো হচ্ছে তাঁর মোবাইলের একটি ‘কল ডাইভারসন’ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির ফোনের পাশাপাশি আর একটি নির্দিষ্ট ফোনে (যেখানে কল ডাইভার্ট করা হয়েছে) যাবতীয় কথা শুনতে পাওয়া যায়। এই একই কাজ করা যায় নজরদারির আওতায় থাকা

মোবাইলের ‘সিম’ নকল করে। পুলিশের পরিভাষায় যাকে সিম ক্লোন করা বলে। এ ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইলে ফোন এলে ক্লোনড সিম লাগানো ফোনটিও একই সঙ্গে বাজবে। এবং শোনা যাবে সব কথা। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রয়োজনে ফোনালাপ রেকর্ডও করা যায়।

এ ছাড়া, অনেক সময় টেলিফোন সংস্থার কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট মোবাইলের ‘কল ডিটেলস রেকর্ড’ বা সিডিআর নেওয়া হয়। সেই রেকর্ড থেকে জানা যায়, ওই ব্যক্তি কার কার সঙ্গে কথা বলছেন। তদন্তের ক্ষেত্রে যা অনেক সময়ই কাজে লাগে গোয়েন্দাদের। আর এই সব আড়িপাতার ক্ষেত্রে আইনি অনুমতি না-থাকলেও পুলিশ বা গোয়েন্দারা টেলিফোন সংস্থার সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সুবিধা আদায় করে নেন। তবে সরকারি সংস্থা বিএসএনএলের ভিজিল্যান্স বিভাগের এক কর্তা বলেন,‘‘স্বরাষ্ট্রসচিবের অনুমতি না-থাকলে আমরা কোনও ফোনে আড়ি পাততে দিই না। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে আমাদের গুলিয়ে ফেললে চলবে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE