Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

যে হাত দিয়ে বিশ্বজয়, সেই হাতকেই এখন ভয়!

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, সারা বিশ্বের বিমানযাত্রীরা হাত পরিষ্কার নিয়ে সচেতন হলে কোনও মহামারির আশঙ্কা ৬৯ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামতে পারে।

হস্ত-কথা: করোনাভাইরাস রুখতে বিশ্ব জুড়েই জোর দেওয়া হচ্ছে হাতের পরিচ্ছন্নতায়। মুখে-চোখে হাত না-দেওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক করা হচ্ছে বারবার। তবু এখনও সচেতন নন অনেকেই। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

হস্ত-কথা: করোনাভাইরাস রুখতে বিশ্ব জুড়েই জোর দেওয়া হচ্ছে হাতের পরিচ্ছন্নতায়। মুখে-চোখে হাত না-দেওয়ার ব্যাপারেও সতর্ক করা হচ্ছে বারবার। তবু এখনও সচেতন নন অনেকেই। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

দেবাশিস ঘড়াই
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৫:৩২
Share: Save:

হাতের ব্যবহারই মানুষকে আলাদা করেছে অন্য প্রাণীদের থেকে। কারণ, মানুষ হাতকে একটি যন্ত্র, একটি প্রতীক, একটি অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করে। নৃতত্ত্ব-বিজ্ঞান এমনটাই জানাচ্ছে।

যেমন, দৃষ্টিহীনদের কাছে হাতই যেন তাঁদের চোখ, মূক-বধিরদের কাছে হাত তৈরি করে তাঁদের নিজস্ব ভাষা। আবার অন্যকে অভিবাদন জানাতে বা তাচ্ছিল্য করতেও হাতকেই মাধ্যম করে মানুষ। গবেষণা বলছে, এক জন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৬-২৩ বার নিজের অজান্তে, প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় (রিফ্লেক্স) হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করেন। ‘কোভিড-১৯’-এর সংক্রমণ ঠেকাতে সেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ারই পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কৌশিক বসু জানাচ্ছেন, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ছন্দেই মানুষ হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে। শিম্পাঞ্জি এবং ওরাংওটাং যত বার হাত দিয়ে মুখ ছুঁয়ে থাকে, সেই একই প্রবণতা মানুষেরও। যদিও ব্যবহারের নিরিখে গোরিলা সব থেকে কম, ওরাংওটাং তার বেশি, শিম্পাঞ্জি আরও বেশি হাতের ব্যবহার করে। ‘‘তবে বিবর্তনের মাধ্যমে হাতের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে মানুষ। প্রতীকী অর্থে বিশ্বজয়ে হাতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’ বলছেন কৌশিকবাবু।

কিন্তু সেই হাতই এখন ভয়ের উৎস! কারণ, মহামারি সংক্রান্ত গবেষণায় হু জানাচ্ছে, ‘বিশ্বের এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়া এক জন বিমানযাত্রীর মাধ্যমে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় একটি নতুন রোগ ছড়াতে পারে।’ সেই সূত্রেই হ্যান্ড-হাইজিন বা হাত পরিষ্কারে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছেন গবেষকেরা।

‘সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর মহামারি সংক্রান্ত তথ্য বলছে, কয়েকশো বছর আগে ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’-এর সংক্রমণ পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপে পৌঁছতে পনেরো বছর সময় লেগেছিল। এক এপিডেমিয়োলজিস্টের কথায়, ‘‘সেই সময়ে মহামারিতে অনেক লোক মারা গেলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় রোগের প্রকোপ নির্দিষ্ট অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকত।’’ এক জন ভাইরোলজিস্ট আবার জানাচ্ছেন, সেখানে উন্নততর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমেই মাত্র দু’মাসে কোভিড-১৯ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে তিনটি দেশ সংক্রমিত হয়েছে। ওই ভাইরোলজিস্টের কথায়, ‘‘এই সংক্রমণে বিমানবন্দরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।’’ যেমন, এ শহর-সহ রাজ্যে এখনও পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে তিন জনই বাইরে থেকে আসা।

অথচ গবেষকেরা জানাচ্ছেন, সারা বিশ্বের বিমানযাত্রীরা হাত পরিষ্কার নিয়ে সচেতন হলে কোনও মহামারির আশঙ্কা ৬৯ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশে নামতে পারে। কারণ, গবেষণা দেখাচ্ছে, এক জন সংক্রমিত রোগী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যত জায়গায় হাত রাখেন, সেগুলির ৪৪ শতাংশেই ব্যাক্টিরিয়া থাকে। কিন্তু শুধু জল এবং সাধারণ সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ফলে ওই সংক্রমণের হার যথাক্রমে ২৩ শতাংশ এবং ৮ শতাংশে নেমে যায়। এক গবেষকের কথায়, ‘‘বিশ্বের সমস্ত বিমানযাত্রীর হাত পরিষ্কারের হার বাড়লে কোনও নির্দিষ্ট এলাকার মোট জনসংখ্যার সংক্রমিত রোগীর হার ১.৫ শতাংশ থেকে ০.৫ শতাংশে নামার সম্ভাবনা রয়েছে।’’

গবেষকেরা এ-ও জানাচ্ছেন, হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করা কখনও প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়, কখনও মুদ্রাদোষে, কখনও মানসিক বা শারীরিক অনুভূতির কারণে ঘটে থাকে। এক গবেষকের কথায়, ‘‘এই রিফ্লেক্সের কিছুটা আমরা জিনের মাধ্যমে পাই। অনেক রিফ্লেক্স অভ্যাসের মাধ্যমেও আয়ত্ত করি। যেমন ঘুম থেকে উঠে ব্রাশের দিকে হাত চলে যাওয়ার রিফ্লেক্স আমাদের আয়ত্ত করা।’’ হস্তলেখ-বিশারদ মোহন বসু বলছেন, ‘‘মহামারি রুখতে হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করা অভ্যাসের ডি-লার্নিং প্রয়োজন। হাত মুখে যাবে না, সচেতন ভাবে এই অভ্যাস তৈরি করলে পরবর্তীকালে সেটাই রিফ্লেক্সে পরিণত হবে।’’

যে ভাবে দুর্ঘটনা এড়াতে চালকের পা আপনা-আপনি ব্রেকে চলে যায়, সে ভাবেই হাত দিয়ে মুখ স্পর্শের প্রতিবর্ত ক্রিয়া মস্তিষ্কে আটকে দিতে পারলে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমবে বলে আশা অনেকের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Hand Sanitisation WHO Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE