ভেল্লোরের হোটেলে ঘরবন্দি ছ’জন। শনিবার। (ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপে ওঁদেরই পাঠানো)
ক’টা দিনের মধ্যে শহর কেমন আমূল বদলে গেল! অথচ, গত বারো বছর ধরে তিনি বিশ্বাস করে এসেছেন ভেল্লোরই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্ত ২২ মার্চের পর থেকে মাজদিয়ার সৃষ্টিধর বিশ্বাসের সেই আস্থায় ফাটল ধরেছে। লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই তাঁদের সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ শুরু করেছে প্রিয় ভেল্লোর। হোটেলের দশ বাই আটের চিলতে ঘরে তিন জন অসুস্থ রোগী এবং তাঁদের সঙ্গে যাওয়া আরও তিন জন। সব মিলিয়ে ছ’টা মানুষের কী হবে এই ভেবে ফের অসুস্থ হয়ে পড়ার উপক্রম কিডনির রোগী সৃষ্টিধরের।
গত পয়লা মার্চ স্ত্রী উল্লাসি বিশ্বাসকে নিয়ে ভেল্লোরে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন কৃষ্ণগঞ্জের মাঝদিয়া গ্রামের সৃষ্টিধর। ২০০৮ সাল থেকে কিডনির রোগে ভুগছেন তিনি। মাঝে মাঝেই চিকিৎসার জন্য আসতে হয় ভেল্লোরে। স্ত্রী উল্লাসি বিশ্বাসের গলায় সিস্ট ধরা পড়ায় আবার তাঁকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
নিঃসন্তান ওই দম্পতির সঙ্গে এসেছিলেন তাঁদের আরেক আত্মীয় মোনালিসা রায়। উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের বাসিন্দা বছর ছাব্বিশের ওই তরুণীর ফুসফুসে সমস্যা। তিন জন রোগীর সঙ্গে আরও তিন জন আত্মীয়— মোট ছ’জন গত পয়লা মার্চ হাওড়া থেকে ট্রেন ধরেন। ৩ মার্চ ভেল্লোরে পৌঁছে ১০ নম্বর, কালিয়াম্মন কলি স্ট্রিটের একটি হোটেলে ওঠেন। এক দিন পর ভেল্লোরের সিএমসি-তে ভর্তি হয়ে যান। তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। উল্লাসির চিকিৎসা শুরু হয় ৫ মার্চ থেকে। এর ক’দিন পর হাসপাতালে ভর্তি হন মোনালিসা। তাঁরও চিকিৎসা চলতে থাকে। তাঁদের দেখভাল করতে থাকেন সঙ্গে যাওয়া তিন আত্মীয় বিশ্বজিৎ রায়, উদয় মণ্ডল এবং শিখা মণ্ডল।
২০ মার্চ সকলের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হয়। তত দিনে করোনা নিয়ে উদ্বেগ শুরু হয়ে গিয়েছে দেশ জুড়ে। ভেল্লোর থেকে ফোনে এ দিন সৃষ্টিধর বলেন, “তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য আমরা স্থানীৈয় এক ট্র্যাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওরা ২৩ মার্চ ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তার আগেই ২২ মার্চ জনতা কার্ফু এবং পর দিন থেকে শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে লকডাউন। আমরা ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো আটকে পড়ি।”
সৃষ্টিধর জানাচ্ছেন, চিকিৎসায় সব টাকাপয়সা খরচ হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফেরার মতো অল্প কিছু টাকা হাতে ছিল তাঁদের। কিন্তু লকডাউনে সেই ফেরার রাস্তা বন্ধ। ফুরিয়ে আসা টাকায় এখন কার্যত একবেলা খেয়ে দিন কাটছে ওই ছ’জনের।
উল্লাসি বলেন, “নারায়ণী গেস্ট হাউস বলে যে হোটেলে আছি তার ঘরভাড়া দৈনিক ৩২০ টাকা। দুটো ঘর নিয়েছি। এসেই এককালীন বারো হাজার টাকা দিয়েছি। কথা ছিল ফেরার দিন বাকি টাকা পরিশোধ করে দেব। কিন্তু এই অবস্থায় হাতে শোধ করার মতো টাকা নেই। গেস্ট হাউসের মালিক রোজ বকেয়া টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। জানি না, কী হবে।”
আটকে পড়া বিশ্বজিৎ রায় বলছেন, “আমরা যোগাযোগ করেছিলাম স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে। তারা সাফ জানিয়ে দেন ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দাদের জন্য এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারবে না। অসহায় লাগছে। কেউ সাহায্য করছে না।”
ভেল্লোরে এখন বাজারদরও অস্বাভাবিক চড়া, জানালেন তাঁরা। চাল ৬০-৬২ টাকা, আলু ৪৫-৫০ টাকা, আটা ৫৫ টাকা, পেঁয়াজ ৬০ টাকা, ২৫০ গ্রাম ভেন্ডি ২৫ টাকা, ছ’টা ডাঁটা ২০ টাকা। এই অবস্থায় সামান্য টাকায় এক বেলা রান্না করে ভাগ করে খাচ্ছেন ওঁরা সকলে। বিভিন্ন জায়গায় সাহায্য চেয়ে ফোন করেও কোনও সুরাহা মেলেনি।
মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন সৃষ্টিধর। প্রায় সুদূর ভেল্লোর থেকে ফোনে তাঁদের আর্জি— “যে ভাবে হোক, আমাদের বাঁচান।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy