ভরসা ত্রাণশিবিরেই। নিজস্ব চিত্র।
রাত থেকেই আতঙ্কটা ছিল। সকাল হতেইসেটা আরও বেশি করে চারিয়ে বসে পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলের ধারেই জলদা, চাঁদপুর এলাকার গ্রামবাসীদের মনে। দিঘা জাতীয় সড়ক থেকে শঙ্করপুর হয়ে যে রাস্তা তাজপুরে পৌঁছচ্ছে, রামনগর ব্লকের সেই রাস্তার ধারেই জলদা আর চাঁদপুর।সমুদ্রের পাড় ঘেঁসেরাস্তা। তার ধারেই একের পর এক গ্রাম।
রাত থেকেই হাওয়ার তেজ যে বাড়ছে, তা টের পাচ্ছিলেন এলাকার মানুষ।তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সমুদ্রের গর্জনও। সকালে যখন ফণী আছড়ে পড়েছে পুরীর কাছে, তখন থেকেই যেন আরও ফুঁসে উঠতে শুরু করে সমুদ্র। পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে যেতে পারে, তা আঁচ করতে পেরেছিলেন দিনরাত সমুদ্র আর নোনাজলের সঙ্গে ঘর করা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের এই মানুষেরা।
বছর পঞ্চাশের সুশীল দলুই আর দেরি করেননি। সমুদ্রের মতিগতি দেখেই গরুবাছুর-সহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে সটান হাজির হন কয়েক বছর আগে তৈরি হওয়া সাইক্লোন রিলিফ সেন্টারে। স্থানীয়দের কাছে যা আয়লা সেন্টার নামে পরিচিত।আয়লার ক্ষতি এখনও দগদগে সুশীলের মনে। বৃহস্পতিবার জলদা সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘সেবার বাঁধ ছাপিয়ে দৈত্যের মতো ঢেউ ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। কিছু বোঝার আগেই জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল গোটা গ্রাম।’’ কোনও মতে পিছনের ঝাউ-বাবলার জঙ্গলে গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন সুশীল।
সেই স্মৃতি আর ফিরে আসুক চান না তিনি। চান না সুশীলের মতো গ্রামের বাকিরাও। তাই সকালবেলা হাওয়ার গতি আর দরিয়ার ঢেউয়ের মতিগতি দেখেই গ্রামের প্রায় ছ’শো পরিবার সকাল ন’টার মধ্যেই সমুদ্রের ধার ঘেঁসে তৈরি হওয়া ‘আয়লা সেন্টারে’ চলে এসেছেন।পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সভাধিপতি দেবব্রত দাস বললেন, ‘‘গোটা জেলায় একশোরও বেশি এরকম সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্রের ধার বরাবর শুধু এই মৎস্যজীবী গ্রামগুলোর জন্যই আছে মোট ১৪টি আয়লা সেন্টার।’’
আরও পড়ুন: ফুঁসছে সমুদ্র, দিঘায় খালি করা হল সমস্ত হোটেল, প্রবল ঝড়বৃষ্টি বাংলার উপকূলে
ঝন্টু দলুই চাঁদপুরের বাসিন্দা। সমুদ্রের পাড়ে বাঁধের জন্য দেওয়া শালখুঁটি আর বোল্ডার দেখিয়ে বললেন, ‘‘জল ওঠা শুরু হলে এই বোল্ডার আর শালখুঁটি দশ সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারবে না। জোয়ারের সময়েই জল বাঁধ ছাপিয়ে যায়। আর এরকম ঝড় হলে তো কথাই নেই। সেই জন্য আমরা কেউ ঝুঁকি নিতে পারিনি।’’
জলদা সাইক্লোন রিলিফ সেন্টার। নিজস্ব চিত্র।
সুশীলের মতোই আইলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সন্ধ্যা দলুই। জলদা রেসকিউ সেন্ডারের দোতলায় ঘরে বসে বললেন, ‘‘আগে তো প্রাণে বাঁচি।’’ তিনি খুব ভাল ভাবেই জানেন, ফণীর সামান্য টোকাতেই মাটিতে মিশে যাবে তাঁর টালির চালের মাটির ঘর।
আরও পড়ুন: সন্ধে থেকে রাজ্যে ঝড়বৃষ্টি, কিছুটা দুর্বল হয়ে ১১৫ কিমি বেগে ভোররাতেই ছোবল মারবে ফণী
জেলা প্রশাসনের দাবি, সন্ধ্যার মধ্যেই এই আয়লা সেন্টারে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। সেই মতো ত্রাণের জিনিসপত্র মজুত করা হচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার ভি সলোমন নিশাকুমার বললেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত ১৫,০০০ গ্রামবাসীকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’’ পরিস্থিতির উপর নজর রাখছেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্তারাও। ইতিমধ্যেই এনডিআরএফের অতিরিক্ত দু’টি দল দিঘা সংলগ্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকা ঘুরে দেখছেন জেলাশাসক পার্থ ঘোষ নিজেও। এ দিকে দফায় দফায় বাড়ছে বৃষ্টির তীব্রতা।
আয়লা সেন্টার থেকে বেরনোর সময় দেখা গেল, জানলা দিয়ে বাইরের উত্তাল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বিজু দলুই। কী দেখছেন, জিজ্ঞাসা করতেই ম্লান হেসে তাঁর জবাব, ‘‘এই সমু্দ্রই সব গিলে খায়। আবার এই সমুদ্রই আমাদের রুটিরুজির জোগান দেয় যে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy