লজ্ঝড়ে কাঠামো নিয়ে চলছে মিনিবাস। ছবি: রণজিৎ নন্দী
ঘুম ভাঙে ঠিকই, তবে কখনও সখনও! কোথাও বড়সড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, তবেই। তা-ও আবার সাময়িক। কয়েক দিনের একটু সক্রিয়তা। তার পরে আবার যেমন কে তেমন। আর নজরদারিতে পুলিশ-প্রশাসনের এই ধারাবাহিক ঢিলেমির ফাঁক গলেই বছরের পর বছর বিনা বাধায় শহরের পথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চলার অযোগ্য, লজ্ঝড়ে সমস্ত বাস। বেসরকারি বাস তো বটেই, বহু সরকারি বাসেরও শোচনীয় হাল। কারও টায়ার রেড রোডের মতো মসৃণ, তো কারও গা থেকে সাপের খোলসের মতো উঠে আসছে টিনের পাত। কোনও বাস হয়তো জানলার ফাটা কাচ নিয়েই ছুটছে। কোনও বাসে আবার আসনের গদি উঠে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে কাঠের তক্তা। সুরক্ষাই হোক বা যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্য— সবেতেই যাদের শূন্য পাওয়ার কথা, শহরের রাস্তায় সেই সমস্ত বাসই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন। প্রশাসন দেখেও দেখে না।
বাসমালিকদের সাফ কথা, ভাড়া না বাড়লে বাসের রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো করা সম্ভব নয়। এ ভাবেই চালাতে হবে। যদিও পরিবহণমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, এই মুহূর্তে ভাড়া বাড়ার সম্ভাবনা নেই।
চাকা মসৃণ হয়ে যাওয়ায় অনেক সময়েই ঠিকমতো ব্রেক কষতে পারে না বাসগুলি। রাস্তা ভিজে থাকলে তো কথাই নেই। মারাত্মক বিপদ ঘটে যেতে পারে। সমস্যার কথা মেনেও নিয়েছেন বেসরকারি বাসমালিকদের একাংশ। কিন্তু তাঁদের যুক্তি, নতুন চাকার অনেক দাম। তাই বিপদ জেনেও সব সময়ে নতুন চাকা কিনতে পারেন না তাঁরা। বড়জোর ‘রিসোল’ করিয়ে নেওয়া হয়। অথবা ভাড়া নেওয়া হয় পুরনো চাকা।
বেহাল: যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তার দাবি উড়িয়ে শহরের পথে চলছে এমনই সব বাস। (১) ভেঙে গিয়েছে বাসের দরজা। নিরাপত্তায় ভরসা দড়ি, (২) এমনই দুরবস্থা টায়ারের, (৩) পরিবর্ত হিসেবে রাখা হয়েছে ক্ষয়ে মসৃণ হয়ে যাওয়া চাকা, (৪) লজ্ঝড়ে কাঠামো নিয়ে চলছে মিনিবাস। ছবি: রণজিৎ নন্দী
ওই বাসমালিকেরা জানাচ্ছেন, ২০১৪ সালে একজোড়া নতুন চাকার দাম ছিল ৩৬ হাজার টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৯-৪১ হাজারে। তাঁদের বক্তব্য, গত চার বছরে ভাড়া না বাড়ায় নতুন চাকা কেনা সম্ভব হচ্ছে না। পুরনো চাকাই ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। দিনে ছ’টি চাকার মোট ভাড়া ৩৫০ টাকা। অধিকাংশ বাসমালিক সেটাই নিচ্ছেন। এক বাসমালিকের কথায়, ‘‘পুরনো চাকা বাধ্য হয়ে ভাড়া নিতে হচ্ছে। ভাড়া না বাড়লে অত দাম দিয়ে নতুন চাকা কী ভাবে কিনব?’’
সোমবারই পরিবহণকর্তাদের সঙ্গে ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বৈঠক করেছে বাসমালিকদের সংগঠন। ওই বৈঠক নিয়ে বাসমালিকেরা সন্তোষও প্রকাশ করেছেন। ভাড়া বাড়লে কি বাসগুলির হাল কিছুটা ফিরবে? নিশ্চিত হবে নিরাপত্তা? সেই আশ্বাস দেননি কেউই। তবে রাজ্য সরকারের মনোভাবের জন্য ভাড়া যদি এ বারও না বাড়ে, তা হলে আদতে যাত্রী-পরিষেবাই যে ধাক্কা খাবে, তা একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন বাসমালিক থেকে সাধারণ যাত্রী— দু’পক্ষই। যাত্রীদের একটি বড় অংশই জানিয়েছেন, দু’চার টাকা ভাড়া বেশি দিতে তাঁরা প্রস্তুত। কিন্তু তার পরিবর্তে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও নিরাপত্তা, এ দু’টি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ভাড়া বাড়ানো হবে না। এমন প্রস্তাবও নেই। তবে তার জন্য যাত্রী-সুরক্ষায় কোনও রকম সমঝোতা করা হচ্ছে না বলেই দাবি পরিবহণমন্ত্রীর। শুভেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘যাত্রীদের নিরাপত্তা দেখার জন্য ট্র্যাফিক পুলিশেরা আছেন, মোটর ভেহিক্লসের অফিসারেরা আছেন। সেই সঙ্গে বাসের সার্টিফিকেট অব ফিটনেসের উপরে নিয়মিত নজরদারি চলে।’’
সত্যিই কি তা-ই? রবীন্দ্র সদন মোড়ে একটি বাসের কাঠামো দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন সুপর্ণা সাহা। তিনি বাসেই নিয়মিত যাতায়াত করেন। সুপর্ণা বললেন, ‘‘এমন অনেক বাস আছে, দেখেই মনে হয়, কী ভাবে চলছে? উত্তর জানি না। জানতে চাইও না। তা হলে তো বাসেই উঠতে পারব না।’’ আর এক বাসযাত্রীর কথায়, ‘‘নিরাপদে যদি যাওয়া যায়, তা হলে এক-দু’টাকা বেশি দিতে তো আপত্তি নেই। কিন্তু রোজই যে রকম দুর্ঘটনা ঘটে শুনি, তাতে নিরাপত্তাটা কোথায়? সরকার আর বাসমালিকদের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে দড়ি টানাটানি চলছে। আর বিপদে পড়ছি আমরা!’’ পুরনো চাকা-সহ বাসের রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যাটা মেনে নিয়ে বেসরকারি বাসমালিকদের সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস’-এর সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পরিবহণ দফতরের সঙ্গে বৈঠকে আমরা প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম। বিষয়টি নিয়ে আমরাও আতঙ্কিত। কিন্তু ভাড়া না বাড়লে প্রয়োজন সত্ত্বেও কিছুই করা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ বাসমালিক সামনের চাকা নতুনই লাগাচ্ছেন। কারণ, সামনের চাকা ফেটে গেলে দুর্ঘটনা এড়ানোটা অসম্ভব হয়ে যায়।’’ আর ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর সহ-সভাপতি দীপক সরকার বলেন, ‘‘যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা তো আছেই। রাজ্য সরকারের দায়িত্ব এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy