বৃষ্টি নামার আগে: বারোদোলের মেলায় ভিড়। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
কখনও শহরের রাস্তায় হাঁটছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। ও দিকে, কলেজ মাঠে পড়ছে বিজেপির অমিত শাহর মিটিংয়ের বাঁশ। অন্য দলের ছোট, বড়, মেজ, নেতারা এসেই চলেছেন। সকাল সন্ধ্যে নরম-গরম ভাষণ, রোড শো, মিছিল, ভোটকর্মীদের বিক্ষোভ।
সব মিলিয়ে যাকে বলে ভোটের সাড়ে বত্রিশ ভাজা! কিন্তু বারোদোলের মেলার তাতে আদৌ হেলদোল আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে আছে তার নিজের মেজাজে।
সপ্তাহখানেক হল কৃষ্ণনগরে শুরু হয়েছে বারোদোলের মেলা। জেলা সদরের কয়েকশো বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পার্বণ।
সে অনেক কাল আগের কথা, যখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সুন্দরী ছোটরানি লক্ষ্মীদেবী সে কালের বিখ্যাত উলার জাতের মেলা দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজকার্যের চাপে মহারাজ তা বেমালুম ভুলে যান। শেষমেশ রানির মান ভাঙাতে রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আস্ত একটা মেলাই বসিয়ে ফেললেন নদিয়ারাজ। বলা হয়, কৃষ্ণনগরের সুবিখ্যাত বারোদোলের মেলা শুরুর পিছনে রয়েছে এমনই এক পত্নীপ্রেমের ইতিহাস।
যদিও কারও মতে, বারোদোল মেলার প্রবর্তক আদৌ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নন। তাঁদের যুক্তি, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখিত ‘অন্নদামঙ্গল’এ কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে অনেক কথা থাকলেও বারোদোলের কোনও উল্লেখ নেই। অন্য একদল গবেষকের মতে, অন্নদামঙ্গল রচিত হয় ১৭৫২ সালে। আর বারোদোলের মেলার সূচনা হয়েছিল ১৭৬৪ নাগাদ। তাই ভারতচন্দ্রের কাব্যে তার কোনও উল্লেখ নেই। বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-নদিয়া, ১৯১০ সালের রিপোর্টে লিখেছিল, সে বারে বারোদোলের মেলায় কুড়ি হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। সেখানে আরও বলা হয়েছিল, মেলা রাজবাড়ির হলেও তাতে সাধারণ মানুষই প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকেন।
রাজার সঙ্গে প্রজার মিলন উৎসব। সংক্ষেপে এই হল বারোদোলের তাৎপর্য। রাজরাজড়ার দিন ফুরোলেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মাঠে প্রায় মাসভর চলা বারোদোলের মেলার আকর্ষণে সামান্যতম ছেদ পড়েনি। বরং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নদিয়ার রাজ-পরিবারের মতে, মানুষ জানেন এ মেলা রাজবাড়ির নয়, এই মেলা তাঁদের নিজেদের মেলা।
ফাল্গুন মাসে রাধাকৃষ্ণের দোলের পর চৈত্র মাসে দোলের উৎসব একমাত্র কৃষ্ণনগরেই হয়। শাস্ত্রজ্ঞ নদিয়ারাজ শাস্ত্র মেনেই সূচনা করেছিলেন বিরল এই উৎসবের।
‘হরিভক্তিবিলাস’ গ্রন্থে চৈত্র মাসের এই দোল উৎসবের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, চৈত্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে দক্ষিণমুখ করে হরি বিগ্রহকে পূজার্চনা করে এক মাস দোলনায় দোলাতে। তাঁর রাজত্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহকে একত্রিত করে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই কাজটিই করেন। বারোটি বিগ্রহের দোল তাই বারোদোল।
এ হেন বারোদোলে ভিড় উপচে পড়াটাই স্বাভাবিক। কলকাতা থেকে কয়েক বছর ধরে মেলায় আসছেন অমিত কুণ্ডু। কাঁচের বাসনপত্রের বড় স্টল তাঁর। তিনি বলেন, “ভোট বলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কেনাবেচা সেই একই রকম।”
বৃষ্টির কারণে রবিবার সন্ধ্যায় ভিড় তুলনায় কম হলেও শনিবার উপচে পড়েছিল মানুষ। কৃষ্ণনগরের পথে তখন হাঁটছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। মেলার ভিড়ে কোনও ছাপ পড়েনি।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মেলায় নাগরদোলা নিয়ে আসছেন দীনেশ জয়সোয়াল। তিনিও বলেন, “খুব ভিড় হচ্ছে। আগের মতোই। ভোট-টোট কিছু বুঝতে পারছি না।”
রাজবাড়ির পঙ্খের কাজ করা সুবিশাল ঠাকুর দালানে বারোদোলের মূল মঞ্চে পূজিত হন দেবতারা। নদিয়ারাজের কুলবিগ্রহ বড় নারায়ণ ছাড়াও আরও বারোটি কৃষ্ণবিগ্রহ থাকে। নামে বারোদোল হলেও শুরুতে সব মিলিয়ে মোট তেরোটি বিগ্রহ থাকত বারোদোলের উৎসবে।
নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সম্পাদক গোকুলবিহারি সাহা বলেন, “বারোদোলের মেলা সে
কালের গ্রামীণ অর্থনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গুরুত্ব বেড়েছে। এবারও ব্যতিক্রম হবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy