গ্রাম থেকে জীবিকার খোঁজে শহরে আসার স্রোত এখন ঊর্ধ্বমুখী। শহুরে জীবনযাপনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে সেই আদত গ্রামবাসীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। এই তথ্য ধরা পড়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক সমীক্ষায়।
কারণটা কী? ওই সমীক্ষা বলছে, পরিবর্তিত খাদ্যাভাস এবং জীবনশৈলীর আমূল বদলের জন্যই ডায়াবেটিস বাসা বাঁধছে ওই শ্রেণির মানুষের মধ্যে। যাঁদের উপরে সমীক্ষা হয়েছে, তাঁদের বয়স ৩০ বছরের উপরে। গ্রাম থেকে এসে তাঁরা তিন-চার বছর বসবাস করছেন শহরে। ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়পর্বে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: শিশুর দেহে বিঁধে ৭ সুচ, ধন্দে পুলিশ
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হয়ে এই সমীক্ষা চালিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)। দেশে কোথায় কোন ধরনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি, তার তথ্যপঞ্জি তৈরির কাজে হাত দিয়েছে তারা। প্রথম পর্যায়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছ’টি রাজ্য, অন্য আটটি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চণ্ডীগড়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে। তাতে গ্রাম থেকে আসা আর্থ-সামাজিক ভাবে দুর্বল, দুর্বলতর মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতার বিষয়টি ধরা পড়েছে বলে দ্য ল্যানসেট ডায়াবেটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দাবি করেছেন আইসিএমআর-এর গবেষকেরা।
ওই গবেষণাপত্র জানাচ্ছে, এমন সব মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ছড়াচ্ছে, যাঁদের সেই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার আর্থিক সামর্থ্য নেই। শহুরে জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার তাগিদে ওই সব মানুষ অতিরিক্ত ক্যালোরিযুক্ত খাবার বা জাঙ্ক ফুডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। অন্য দিকে তাঁদের কায়িক পরিশ্রমের মাত্রাও কমে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যদিন লড়াই করে বেঁচে থাকার চাপ এবং পরিবেশ-দূষণ।
গবেষণাপত্রের মূল লেখক আইসিএমআর-এর বিজ্ঞানী আর এম আনজানা-র দাবি, এর আগে ভারতে ডায়াবেটিস নিয়ে এত বড় সমীক্ষা হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষদের রক্তে শর্করার পরিমাণ মাপা হয়েছে। যে-সব গ্রাম থেকে তাঁরা এসেছেন, নেওয়া হয়েছে সেখানকার বাসিন্দাদের রক্তের শর্করার মাত্রার খতিয়ানও। দুই গোষ্ঠীর খাদ্যাভাস এবং জীবনশৈলীর পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করেছেন গবেষকেরা। আনজানা জানান, যে-সব গ্রামীণ মানুষ শহরে এসে বসবাস করছেন, তাঁদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতার বিষয়টি সেই সমস্ত তথ্য থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
সমীক্ষকেরা জানাচ্ছেন, সমীক্ষায় যাঁদের ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে, তাঁদের অধিকাংশেরই সেই রোগের ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই। প্রথম পর্যায়ের সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, কেরলের শহরগুলিকে রাখা হয়নি। আইসিএমআর পরবর্তী পর্যায়ে ওই সব শহরে সমীক্ষা চালাবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
প্রথম পর্যায়ের সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ না-থাকলেও ত্রিপুরা ছিল। ত্রিপুরার তথ্য দেখে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তিত অনেক এন্ডোক্রিনোলজিস্ট। ত্রিপুরায় গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ১৫.৫ শতাংশের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতা ধরা পড়েছে। গ্রামীণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতা ৭.২ শতাংশ।
‘‘ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের খাদ্যাভাস, শারীরিক গঠন, আচার-ব্যবহার সবই প্রায় এক রকম। তাই আইসিএমআর-এর সমীক্ষায় ত্রিপুরায় যে-ফল মিলেছে, তা থেকে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতেই পারে,’’ বলছেন কলকাতার ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইপিজিএমইআর)-এর সঙ্গে যুক্ত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। আইসিএমআর-এর প্রাথমিক সমীক্ষার ফল দেখে সতীনাথবাবুর প্রতিক্রিয়া, যে-মানুষটি গ্রামে রোজ কয়েক কিলোমিটার হাঁটতেন বা সাইকেলে ঘুরতেন, শহরে এসে সামান্য দূরত্বে যেতেও তিনি বাস বা অটো ব্যবহার করছেন। অথবা স্কুটার বা বাইক ব্যবহার করছেন। ফলে তাঁর কায়িক পরিশ্রমটাই আর হচ্ছে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে শহুরে খাবার। ‘‘দুইয়ে মিলে ডায়াবেটিসের জাঁকিয়ে বসাটাই স্বাভাবিক,’’ মন্তব্য সতীনাথবাবুর।
দ্বিতীয় পর্যায়ে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ডায়াবেটিস নিয়ে সমীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছেন বলে জানান সতীনাথবাবু। ওই সমীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের চিত্রটা কী দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য কৌতূহল রয়েছে এন্ডোক্রিনোলজিস্ট মহলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy