গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সম্পর্কের মধ্যে বিশ্বাস বিষয়টায় ইদানীং কেমন যেন ভাঙন আসছে। অনেক ঘটনাই নজরে আসে। কিন্তু, সেই সব কারণে আত্মহত্যাকেই বেছে নিতে হবে, সেটার কোনও কারণ দেখি না।
এক জন মানুষ যখন আত্মহত্যা করেন, এর মধ্যে দিয়ে তাঁর রাগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যে রাগের অভিমুখ নিজের দিকে। যে সম্পর্কের মধ্যে এত প্রেম, এত তীব্রতা ছিল, তার ভাঙচুর বা বিশ্বাসঘাতকতার মধ্যেও অতটাই রাগের তীব্রতা আসা স্বাভাবিক। মুশকিল হল, সেই রাগ যখন অন্যের দিকে চালিত করার আর কোনও পথ খোলা থাকছে না, তখন তা নিজেকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সোনারপুরের এই তরুণটির মতো আরও যাঁরা এই ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা যদি সঙ্কোচের গণ্ডি টপকে একটু সামাজিক এবং মানসিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেন, তা হলে বোধহয় জীবন শেষ করে দেওয়ার দরকার পড়ে না।
আমরা অনেক ক্ষেত্রে দেখতে পাই, কাঙ্ক্ষিত মানুষটির চলে যাওয়ার ইঙ্গিত মানেই কারও কারও একটা আত্মপরাজয়ের গ্লানি তীব্র হয়ে ওঠে। সেখানে ভালবাসার মানুষটিকে ফেরত পাওয়ার থেকেও বা তার ভালতে বাস করার থেকেও নিজের ক্ষমতা এবং তাকে আদায় করার যোগ্যতা প্রতিস্থাপিত করাই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সোনারপুরের এই তরুণীও তাঁর সেই তাগিদটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বলে মনে হয়। তা না হলে সম্ভাব্য বিচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়ে এ ধরনের নির্যাতনের ছক সে বাঁধবেই বা কেন?
আরও পড়ুন: নগ্ন ছবি দেখিয়ে ‘প্রেমিকার’ ব্ল্যাকমেল, আত্মঘাতী সোনারপুরের তরুণ
সঙ্গীর হুমকি এবং তার প্রেক্ষিতে অন্য জনের জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো ঘটনা আমরা আগেও দেখেছি। যখন পুরুষ সঙ্গী অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও তুলেছেন এবং সেটি সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁর বান্ধবীকে হেনস্থা করার চেষ্টা করেছেন। বা ছড়িয়ে দেননি, কিন্তু দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু, সোনারপুরের এই ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের আশ্চর্যের কারণটা অন্য। এ ক্ষেত্রে গোটা লিঙ্গের গল্পটা গুলিয়ে গেল। কিন্তু তলিয়ে দেখতে গেলে যেটা মাথায় রাখতে হবে, হেনস্থা বা নির্যাতনের আদতে কোনও লিঙ্গ হয় না।
নিজের স্বার্থ হাসিল করার দরুণ কেউ যখন অন্তরঙ্গতাকে হাতিয়ার করে এবং হুমকির হুজ্জুতি চালায়, তখন সামাজিক লজ্জা-টজ্জা কাটিয়ে আমরা কেন আইনি পরামর্শ নেব না? কেন নিজেকে শেষ করে দেব? অন্তরঙ্গ ছবি তোলা বা তাকে নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে কোথাও কি সঙ্গীকে কতটা ভালবাসি তা প্রমাণ করার দায় থেকে যায়? তা না হলে ক্যামেরাবন্দি হওয়ার আগেই তো আপত্তি ওঠার কথা ছিল! সেটা না করে পরে এসে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কোনও মানে নেই।
প্রেমের সম্পর্কে যাওয়ার আগে, সেটি তার রূপ বদলাতে পারে, তাতে অন্য মানুষের ছায়া পড়তে পারে— এমন সব সম্ভাবনার জন্য একটা মানসিক প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকা খুব জরুরি। তা না হলে, আত্মহত্যার হুমকি বা অন্য মানুষটিকে লাঞ্ছিত করার হুমকি— ইত্যাদি দিয়ে সত্যিই যদিএক জনকে বেঁধে রাখতে হয়, তাতে অনেক বেশি আত্মগ্লানি আসে, প্রেম থাকে বলে আমার মনে হয় না।
আরও পড়ুন: ভ্যানিশিং কালির কামাল, উধাও টাকা
সম্প্রতি যে ক’টি ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে, প্রত্যেকটি প্রেমের গল্পই কিছু ক্ষণের মধ্যে এমন দাঁত-নখ বার করে ফেলছে যে, তাতে আমাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো কোথাও যেন পথভ্রষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয়। দু’জন সম্মত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একটি প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে থাকলে তাদের মধ্যে কিছু আদরের ভাষা তৈরি হতেই পারে। কিন্তু, সেই ভাষার এমন অপব্যবহার ঘটবে কেন?
সোনারপুরের ঘটনাটির প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে, ভালবাসা এবং আদরের গোটা সংজ্ঞাটাই এখানে অনেক বেশি ক্ষমতার মুঠোর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যেখানে, সঙ্গী ছেড়ে চলে যেতে পারে এই আশঙ্কা আসামাত্র আমরা আসলে যে ধরনের প্রয়োগ দেখলাম, সে ভাষা দমনের। আবারও যেটা প্রমাণিত হয়, ক্ষমতারও কোনও লিঙ্গ হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy