Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দেশে কি আইনকানুন নেই! ক্ষুব্ধ ধৃতের বাবা

এক জন কলেজে ঢুকে সদ্য ডেকরেটরের ব্যবসায় নেমেছেন। বাকি তিন জন ওই ব্যবসার কর্মী এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। বীরভূমের সিজেএম নিগ্রহের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এটাই পুলিশের স্কোর! শনিবার রাতে সিউড়িতে জেলা তৃণমূলের কার্যালয়ের একেবারে সামনে চাঁদার জুলুমের শিকার হন বীরভূম জেলার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়।

প্রিজন ভ্যান ঘিরে ধৃতদের পরিজনদের ভিড়। মঙ্গলবার। - নিজস্ব চিত্র

প্রিজন ভ্যান ঘিরে ধৃতদের পরিজনদের ভিড়। মঙ্গলবার। - নিজস্ব চিত্র

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৭
Share: Save:

এক জন কলেজে ঢুকে সদ্য ডেকরেটরের ব্যবসায় নেমেছেন। বাকি তিন জন ওই ব্যবসার কর্মী এবং স্কুল-কলেজ পড়ুয়া। বীরভূমের সিজেএম নিগ্রহের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এটাই পুলিশের স্কোর!

শনিবার রাতে সিউড়িতে জেলা তৃণমূলের কার্যালয়ের একেবারে সামনে চাঁদার জুলুমের শিকার হন বীরভূম জেলার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়। ওই ঘটনায় সোমবার দিব্যেন্দু সরকার, মীর সুমন ও তাঁর দাদা মীর মিমন ও মহম্মদ আসিফ হোসেন নামে চার জনকে গ্রেফতার করে সিউড়ি থানার পুলিশ। ধৃতদের বিরুদ্ধে দু’টি জামিন অযোগ্য-সহ ছ’টি ধারায় মামলা হয়েছে।

বিচারক নিগ্রহের ঘটনায় সোমবার পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন জেলা আদালতের আইনজীবীরা। এ বার ওই চার জনের গ্রেফতারি নিয়ে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে। কালীপুজোর উদ্যোক্তাদের বাদ দিয়ে মণ্ডপ তৈরির দায়িত্বে থাকা ডেকরেটর সংস্থার মালিক ও তাঁর ৩ কর্মীকে কেন ধরা হল, এই প্রশ্ন তুলে সকাল থেকেই সিউড়ি থানায় বিক্ষোভ দেখান ধৃতদের পরিজন ও এলাকাবাসী। তাঁদের সঙ্গে পুলিশের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও হয়। চাপের মুখে পুলিশের পক্ষে আশ্বাস দেওয়া হয়, ধৃতেরা নির্দোষ হলে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে স্মারকলিপি দিয়ে থানা ছাড়েন ক্ষুব্ধ পরিজন। বেরিয়ে এসে তাঁরা এসপি অফিসের সামনেও বিক্ষোভ দেখান। অবরোধ করেন জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনেও।

সিজেএম নিগ্রহ-কাণ্ডে প্রথম থেকেই পুলিশের সক্রিয়তা চোখে পড়েনি। শনিবার রাতে পুলিশ বিচারকের অভিযোগ নিতে চায়নি বলেও অভিযোগ। সিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে অতীতে একাধিক বার ধমক খেয়েছে বীরভূম জেলা পুলিশ। পাড়ুইয়ের একাধিক মামলায় পুলিশের ভূমিকায় ভরা এজলাসে সিজেএমকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছে। গত নভেম্বরে পুলিশ হেফাজতে থাকা এক ব্যক্তিকে ফের ধৃত দেখিয়ে বিচারকের ভর্ৎসনার
মুখে পড়ে পুলিশ। বিচারক যাকে বলেছিলেন, ‘মিসক্যারেজ অব জাস্টিস’ (বিচারের গর্ভপাত)! তিনি সিজেএম পাড়ুই থানার ওসিকে সরিয়ে দেওয়া, তদন্তকারী অফিসার বদল-সহ একাধিক সুপারিশও করেন। এর পর সাত্তোরের নির্যাতিতার মামলাতেও পুলিশের কাজকর্মে রুষ্ট হন সিজেএম। এই প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে শাসক দলের হয়ে কাজ করার অভিযোগও তুলেছিলেন বিরোধীরা। সেই সিজেএম-কেই এ ভাবে হেনস্থা করার ঘটনায় ‘পরিকল্পিত চক্রান্ত’-এর আঁচ পাচ্ছে বিভিন্ন মহল। কেউ কেউ বলছেন, ওই ঘটনায় শাসকদলের ইন্ধন রয়েছে। আইনজীবীদের একাংশও বলছেন, বিচারকেরউপর বহু দিন ধরেই ক্ষুব্ধ ছিল পুলিশ ও শাসকদলের একাংশ। জেলায় তৃণমূলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে চাঁদা তোলার ঘটনায় শাসকদলের প্রশ্রয় নেই, এ কথা তাঁরা মানতে পারছেন না। তাই অপরাধীদের ধরার ক্ষেত্রে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তায় ‘অন্য সমীকরণ’ খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে। জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ফোন ধরেননি। তবে, শাসকদলের এক জেলা নেতার দাবি, ‘‘যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু, এর পিছনে দলের কোনও হাত নেই।’’

বিরোধীরা তা মানতে নারাজ। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর উচিত ছিল, জেলার পুলিশ সুপারকে ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠানো। গুন্ডাগিরির হাত থেকে বিচারকও রেহাই পাচ্ছেন না। আর মুখ্যমন্ত্রী বসে অসহিষ্ণুতা নিয়ে কবিতা লিখছেন!’’

এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় বীরভূম পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। সিজেএম নিগ্রহ-কাণ্ডেও পুলিশ শেষ অবধি দোষীদের আড়াল করবে বলে আশঙ্কা তাঁদের। স্থানীয় সূত্রের খবর, ধৃত দিব্যেন্দু সিউড়ি থানার গোবিন্দপুরের বাসিন্দা। যে পুজো উদ্যোক্তাদের দিকে অভিযোগের তির, সিউড়িতে জেলা তৃণমূল কার্যালয়ের অদূরে থাকা ওই মণ্ডপ তৈরিরই দায়িত্ব নিয়েছিলেন দিব্যেন্দু। বাকিরা সিউড়ি পুরাতন লাইন এলাকার বাসিন্দা। প্রত্যেকেই মণ্ডপ নির্মাণে দিব্যেন্দুর সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন।

দিব্যেন্দুর বাবা তপন সরকার জানান, ছেলে কলেজে ঢোকার পরে বেশ কিছু দিন ধরে প্যান্ডেলের ব্যবসায় নেমেছে। ওই ক্লাবটি ছাড়াও এ বার সিউড়ির আরও কয়েকটি কালীপুজোর মণ্ডপ তৈরির দায়িত্ব নিয়েছেন। অসহায় ভাবে তপনবাবু বলেন, ‘‘সোমবার দুপুরে মণ্ডপ তৈরির কাজ তদারকির সময়ই পুলিশ ছেলেকে ধরল। ওর কী দোষ? দেশে কি আইনকানুন বলে কিছু নেই? আমরা শেষ দেখে ছাড়ব!’’ একই সুর ধৃত মীর মিমন ও মীর সুমনের দিদি নিলোফার বিবির। তাঁর কথায়, ‘‘বিচারককে যখন প্রকাশ্য রাস্তায় মারধর করা হল, তখন পুলিশ কী করছিল? বারো ঘণ্টা পরে পুলিশ কাদের ধরল? যারা নাকি মণ্ডপ তৈরি করছিল! ওদের অন্যায়টা কোথায়?’’ আসিফের দাদা মহম্মদ আনিস জানান, তাঁর ভাই সবে একাদশ শ্রেণিতে উঠেছে (তবে সে সাবালক)। ‘‘মানুষ কোথায় বিচার পাবে,’’— প্রশ্ন আনিসের। জেলা পুলিশের এক কর্তার অবশ্য দাবি, ‘প্রাথমিক তদন্তে এই চার জনের বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় যুক্ত থাকার তথ্যপ্রমাণ মিলেছে।

সিজেএম ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায় ছুটিতে থাকায় এ দিন ধৃতদের হাজির করানো হয় ভারপ্রাপ্ত সিজেএম ঋষি কুশারির এজলাসে। সব পক্ষের কথা শুনে তিনি দিব্যেন্দু ও মিমনকে তিন দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠান। বাকিদের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত জেল হাজত হয়েছে। আগামী শুক্রবার মামলার পরবর্তী শুনানি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE