Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নাবালিকার বিয়ে নয়, ক্লাস নিচ্ছেন ওসি

বেগুনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়। দুপুর দু’টো। শ্রেণিকক্ষে শতাধিক ছাত্রী অপেক্ষা করছে পরের ক্লাসের জন্য। এর মধ্যেই প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকলেন বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি। ছাত্রীরা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফিসফিস করে কেউ বলছে, ‘‘হ্যাঁ রে, এটাই কি তাহলে আমাদের নতুন স্যার?’’

পড়ুয়াদের সঙ্গে বেলডাঙার ওসি অরূপ রায়।— নিজস্ব চিত্র।

পড়ুয়াদের সঙ্গে বেলডাঙার ওসি অরূপ রায়।— নিজস্ব চিত্র।

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়
বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:৫৬
Share: Save:

বেগুনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়। দুপুর দু’টো। শ্রেণিকক্ষে শতাধিক ছাত্রী অপেক্ষা করছে পরের ক্লাসের জন্য। এর মধ্যেই প্রধানশিক্ষকের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকলেন বছর চল্লিশের এক ব্যক্তি। ছাত্রীরা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ফিসফিস করে কেউ বলছে, ‘‘হ্যাঁ রে, এটাই কি তাহলে আমাদের নতুন স্যার?’’ চাপা গলায় কারও প্রতিক্রিয়া, ‘‘লোকটা কেমন গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে দ্যাখ!’’ গুঞ্জন থামালেন প্রধানশিক্ষক, ‘‘শোন, এই ভদ্রলোক বেলডাঙা থানার বড়বাবু। আজ তোমাদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে কথা বলতে স্কুলে এসেছেন।’’ ফের শুরু ফিসফাস, ‘‘আরিব্বাস! এই লোকটা তাহলে পুলিশ!’’

ক্লাসশুদ্ধ ছাত্রীকে অবাক করে মিটিমিটি হাসতে হাসতে বেলডাঙা থানার ওসি অরূপ রায় চক-ডাস্টার হাতে সোজা ব্ল্যাকবোর্ডের কাছে। খসখস করে বোর্ডের উপরে আওয়াজ তুলে লিখলেন নিজের নাম ও মোবাইল নম্বর। সঙ্গে থানার ল্যান্ডফোন নম্বরও। বললেন, ‘‘এই নম্বরটি তোমরা নিজেদের কাছে রেখে দিও। কোনও রকম বিপদ হলে, বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইলে কিংবা রাস্তা-ঘাটে কেউ উত্যক্ত করলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবে।’’

ক্লাসে উপস্থিত নবম ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রীরা এ বার যেন অনেকটাই সহজ হয়েছে। তাঁদের একজন উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল, ‘‘স্যার, গ্রামের কারও যদি আঠারোর আগে বিয়ে হয় তাহলে কি এই নম্বরে ফোন করতে পারব?’’ অরূপবাবুর সহাস্য উত্তর, ‘‘অবশ্যই পারবে। ফোন করতে অসুবিধা হলে এসএমএসও পাঠাতে পার। প্রয়োজনে থানার মহিলা পুলিশকর্মীর সঙ্গেও কথা বলতে পারবে। কোনও সঙ্কোচ বা ভয় করবে না তোমরা।’’

এরপর টানা প্রায় ঘণ্টা দু’য়েকের ক্লাসে উঠে এল নারীপাচার, শ্লীলতাহানি, নাবালিকা বিয়ের সমস্যার মতো অনেক বিষয়। প্রাণ খুলে কথা বলল ছাত্রীরা। মন দিয়ে সে সব কথা শুনলেন ‘বড়বাবু’। কিন্তু হঠাৎ এমন উদ্যোগ কেন?

মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু থানাতে কাজ করার পরে অরূপবাবুর অভিজ্ঞতা—নাবালিকার বিয়ে, নারী নিগ্রহ, শ্লীলতাহানি কিংবা যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা আকছার ঘটছে। কিন্তু সে সব বিষয়গুলি সবসময় থানা পর্যন্ত আসছে না। অনেক অভিভাবক যেমন সচেতনতার অভাব থেকে কিংবা অভাবি পরিবারে ‘বোঝা হালকা’ করতে নাবালিকার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। অনেকে আবার মেয়ের যৌন নিগ্রহের বা শ্লীলতাহানির ঘটনা নিয়েও থানা-পুলিশ পর্যন্ত ‘বাড়াবাড়ি’ করতে চান না। সমস্যাটা শুরু হয় সেখানেই। এতে যেমন অপরাধী দোষ করেও পার পেয়ে যায়। অন্যদিকে, নির্যাতিত কিংবা লাঞ্ছিত মেয়েটিও প্রতিবাদের সাহস হারিয়ে েফলে।

অরূপবাবু থানার কাজ সামলে সময় করে যোগাযোগ করছেন স্কুলের প্রধানশিক্ষকদের সঙ্গে। তারপর একদিন হাজির হয়ে যাচ্ছেন সটান ক্লাসরুমে। ইতিমধ্যে বেলডাঙার মির্জাপুর হাজি সোলেমান উচ্চ বিদ্যালয়, বেগুনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো বেশ কয়েকটি স্কুলে ক্লাস নিয়েছেন। তালিকায় রয়েছে আরও কয়েকটি স্কুল। অরূপবাবুর দাবি, ইতিমধ্যে তিনি তিনটে নাবালিকা বিয়ে রুখতে পেরেছেন। সে কৃতিত্বের কিছুটা তিনি ছাত্রীদেরও দিয়েছেন। ছাত্রীদের মধ্যে ক্রমশ ভয় ও জড়তা যে কাটছে সে কথা কবুল করছেন বেগুনবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু কাইউমও। তাঁর কথায়, ‘‘এর সুফলও মিলতে শুরু করেছে। ছাত্রীরাও খুব খুশি হয়েছে বড়বাবুর ক্লাস করে। এটার দরকার ছিল।’’ অরূপবাবুর এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর-সহ জেলা পুলিশের কর্তারাও।

ঘড়ির কাঁটা চারটে ছুঁইছুঁই। স্কুলের জানালার বাইরে পড়ন্ত বিকেলে ছুটির হাতছানি। কিন্তু সে দিকে কারও যেন খেয়াল নেই। অরূপবাবু গল্পের মেজাজে বলে চলেছেন—‘বুঝলে, আমি তখন হরিহরপাড়া থানায়। মোবাইলে তোমাদের বয়সী এক ছাত্রীর সঙ্গে ফোনে আলাপ হয়েছিল এক যুবকের। তারপর প্রায়ই তাদের ফোনে কথা হত। একদিন ছেলেটিকে বিশ্বাস করে মেয়েটি বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়ে। খুব কষ্ট করে মেয়েটিকে পাচারকারীদের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিলাম। তাই ফোনও খুবই সচেতন ভাবে ব্যবহার না করলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।’’

ক্লাস শেষ। স্কুল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন ‘বড়বাবু’। কিছু দূর যাওয়ার পরে তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল প্রিয়া দত্ত, সোনিয়া খাতুন, আমিনা খাতুন, রিজিয়া সুলতানাদের কথায়, ‘‘স্যার সময় পেলে আবার আসবেন কিন্তু।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police marriage mobile murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE