অরুণাচল দত্তচৌধুরী
ডেঙ্গি নিয়ে ধুন্ধুমার বিতর্ক ও তরজার মধ্যেই অকুতোভয় তিনি একের পর এক পোস্ট করেছিলেন নিজের ফেসবুক পেজে। খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, কী ভাবে একটি জেলা হাসপাতালে অপ্রতুল পরিকাঠামো আর লোকবল নিয়ে স্রোতের মতো ধেয়ে আসা জ্বরের রোগী সামলাতে অসহায় হয়ে পড়ছেন। জানিয়েছিলেন, ডেঙ্গিতে মৃত্যু জেনেও ‘পরিস্থিতির চাপে’ ডেথ সার্টিফিকেটে অন্য কারণ লিখে কী ভাবে অপরাধবোধে ভুগছেন। লিখেছিলেন, ‘রক্তচোখের ভয়ে ভীত কেন্নোর মতো সন্ত্রস্ত এই আমি অভাগার ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ লিখছি ‘ফিভার উইথ থ্রম্বোসাইটোপিনিয়া’।
বারাসত জেলা হাসপাতালের প্রবীণ চিকিৎসক অরুণাচল দত্তচৌধুরীর এমন ‘বিস্ফোরক’ পোস্ট দেখে অনেকেই কমেন্ট করেছিলেন— ‘শোকজ’ খেতে পারেন যে কোনও সময়’! সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। সরকারি তথ্যপঞ্জি প্রকাশ্যে আনার ‘অপরাধ’-এ তাঁকে ‘কশন লেটার’ দেন বারাসত জেলা হাসপাতালের সুপার সুব্রত মণ্ডল। জবাবে ৬২ বছরের শিক্ষক-চিকিৎসক লিখেছিলেন—‘ফেসবুক-পোস্ট সংক্রান্ত কোনও সার্ভিস রুল আছে বলে আমার জানা ছিল না। তবু এর জন্য দুঃখিত’। এর পরে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য দফতর তাঁকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাসপেনশনের চিঠি ধরিয়ে জানিয়েছে, বিষয়টির তদন্ত শুরু হচ্ছে।
হাসপাতালের নোটিস বোর্ডে প্রতিদিন কত রোগী ভর্তি হচ্ছেন, কত জন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মী রয়েছেন— তার হিসেব টাঙানো থাকে। তেমনই একদিনের নোটিস বোর্ডের ছবি তুলে অরুণাচলবাবু ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। তাতে দেখা যায়, ২৪০ জন রোগীর জন্য চিকিৎসক রয়েছেন ১ জন, নার্স ৩ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ১ জন এবং ১ জন সাফাইকর্মী। একেই ‘সরকারি তথ্য ফাঁস’ হিসেবে দেখিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। অরুণাচলবাবুর কথায়, ‘‘নোটিসবোর্ডের ছবি তুলে পোস্ট করাটা ছিল আমার অন্যায়। এমন অন্যায় আমি আগেও করেছি। এ রাজ্যের লোক পুজোতে বেড়াতে গিয়ে বাইরে থেকে ডেঙ্গি নিয়ে এসেছে বলে সরকার যে দাবি করেছে, তা নিয়ে একটা কবিতা পোস্ট করেছি।’’
এখন কি আফশোস হচ্ছে? অরুণাচলবাবুর জবাব, ‘‘এই বয়সে পৌঁছে এটুকু মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে না! আমার কোনও আফশোস নেই।’’ ‘‘যাঁরা আমাকে ৬০ বছরে অবসর নিতে দেয়নি, তাঁরাই এখন সাসপেন্ড করছে’’— মন্তব্য তাঁর।
রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর বক্তব্য, ‘‘অরুণাচলবাবু সরকারি কাজ করেন। তার কিছু নিয়ম আছে। তিনি তা লঙ্ঘন করেছেন বলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’ চিকিৎসদের বেশির ভাগ সংগঠনই অরুণাচলবাবুর পাশে। অ্যাসোসিয়েশন অফ হেল্থ সার্ভিস ডক্টর্স-এর গৌতম মুখোপাধ্যায়, ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের রেজাউল করিমের বক্তব্য, একজন সরকারি চিকিৎসক চাটুকারবৃত্তি না করে সত্যি চিত্রটা তুলে ধরলেন। সরকারের সেগুলি সংশোধন করা উচিত ছিল। কিন্তু উল্টে তাঁকেই সাসপেন্ড করা হল! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র টুইটারে সরকারের ভূমিকার নিন্দা করেছেন।
অরুণাচলবাবু বলেন, ‘‘হাসপাতালের ফ্লোরে থিকথিক করছে জ্বরের রোগী। সকলকে স্যালাইন পর্যন্ত দেওয়া যাচ্ছে না। আমরা কয়েক জন ডাক্তার অধিকাংশ রোগীকে ছুঁয়েই দেখতে পারছি না! জ্বর পুরোপুরি কমার আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। এটা জানানো যদি অপরাধ হয়, তা হলে অপরাধ করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy