Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

গাছে চড়তেই ভয় পেতেন দুলাল, টাওয়ারে উঠলেন কী করে?

সিবিআই তদন্ত চেয়ে তাঁরা এ দিন থেকে চার দিনের জন্য পুরুলিয়ায় জেলাশাসকের অফিসের সামনে অবস্থানে বসেছেন।

গ্রামের বাড়িতে ত্রিলোচনের শোকার্ত মা। —নিজস্ব চিত্র।

গ্রামের বাড়িতে ত্রিলোচনের শোকার্ত মা। —নিজস্ব চিত্র।

প্রশান্ত পাল
বলরামপুর শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৮ ০০:২১
Share: Save:

যে লোকটা ছেলের আবদারে গাছে উঠে আম পেড়ে দিতে পারেননি, তিনি কী ভাবে টাওয়ারে চড়ে আত্মহত্যা করবেন? এই প্রশ্নই ঘুরছে মৃত বিজেপি কর্মী দুলাল কুমারের গ্রাম বলরামপুরের সুপুরডিতে। সেই প্রশ্ন তুলেই মঙ্গলবার পুরুলিয়ার পথে নেমেছিলেন বিজেপি কর্মীরা। দুলালের মতোই কিছু দিন আগে বলরামপুরের সুপুরডি গ্রামে আর এক বিজেপি কর্মী ত্রিলোচন মাহাতোর মৃত্যু হয়। দু’টি ঘটনাতেই সিআইডি পুলিশকে তদন্তে সাহায্য করতে নামলেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না বিজেপি নেতৃত্ব। সিবিআই তদন্ত চেয়ে তাঁরা এ দিন থেকে চার দিনের জন্য পুরুলিয়ায় জেলাশাসকের অফিসের সামনে অবস্থানে বসেছেন।

বলরামপুরের ডাভা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখনও থমথমে এলাকা। অশৌচ পালন করছেন দুলালের পরিবার। তাঁদের পাশে পড়শিরা। কাছা পরে থাকা দুলালের বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া আদিত্য বলে, ‘‘বাবাকে কত বার গাছ থেকে আম পেড়ে দেওয়ার জন্য বায়না করেছি। কিন্তু, বাবা গাছে চড়তেই জানত না।’’ এরপরেই তার প্রশ্ন— ‘‘তাহলে পুলিশ কী ভাবে বলছে বাবা গলায় দড়ি দিতে টাওয়ারে উঠেছিল? বাবাকে যারা দেখেছে, তারা কেউ ওই কথা বিশ্বাস করবে না।’’ একই কথা দুলালের স্ত্রী মনিকারও।

দুলালের খুড়তুতো দাদা কৃষ্ণপদ ও ভাইপো দীনবন্ধুর প্রশ্ন, দুলালের হাতে ও পায়ে কাদা থাকলেও চটি পরিপাটি করে পায়ের নীচে রাখা ছিল। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এত সাজিয়ে-গুছিয়ে কেউ আত্মহত্যা করে?’’ গ্রামবাসী লম্বোদর কুমার, হারাধন কুমার দাবি করেন, গেঁড়ুয়া পঞ্চায়েতের মধ্যে বিজেপি সব থেকে বেশি ভোট পেয়েছে ডাভা-গোপলাডি বুথে। এত সাফল্য পেয়েও কেন তিনি আত্মহত্যা করতে যাবেন?

আরও পড়ুন: ‘লিখে নিন, আর কোনও বিজেপি কর্মী খুন হবে না, কী ভাবে রুখতে হয় দেখাব’

কৃষ্ণপদ পুলিশের কাছে এলাকার তৃণমূলের ছয় কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে দুলালকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করার অভিযোগ সোমবার পুলিশের কাছে দায়ের করেন। যদিও বলরামপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সুদীপ মাহাতো স্বীকার করেন, ‘‘দু’টি মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের দলের কিছু কর্মী-সমর্থকের নামে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। ভয়ে তাঁরা গ্রাম ছেড়েছেন। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে গ্রামে গিয়ে আমরা লোকজনের সঙ্গে কথা বলব।’’

দলের কর্মী ও পড়শি প্রকাশ কুমার, লম্বোদর কুমাররা বলেন, ‘‘ভোটের আগে দুলাল বারবার এলাকায় দাবি করত, ‘তোরা আমার পাশে থাক। এ বার তৃণমূলকে হারাবই’। এই কথাটাই মনে হয় ওর সর্বনাশ ডেকে আনল। তাঁরা মোবাইলে বিজেপির বাইক মিছিলের ভিডিয়ো দেখছিলেন। দুলালের ছোট ছেলে আদর্শ মায়ের কাছাকাছি ঘুরছিল। মোবাইলে বাবার ছবি দেখার জন্য সেখানে ছুটে গেল দুলালের এক রত্তি ছোট ছেলে আদর্শ। ‘জয় শ্রীরাম’ চিৎকার করে দুলাল বাইক নিয়ে ছুটে যাচ্ছে দেখে আদর্শ বলে ওঠে— ‘‘ওই তো বাবা।’’

ঘুরে ফিরে এ দিনও শুক্রবার রাতে দুলালের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাই তাঁর পরিবার, পড়শিদের মুখে শোনা গিয়েছে। মনিকা জানাচ্ছিলেন, শুক্রবার রাতে দুলালের যখন খোঁজাখুঁজি শুরু হয়, সেই সময়ে বাড়ির পিছন দিকে অন্ধকারে তাঁর মনে হয়েছিল, কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। মনিকা বলেন, ‘‘তখন আমি চিৎকার করি। কেউ সাড়া দেয়নি। পরে পড়শিদের ওই জায়গাটা খোঁজাখুঁজি করতে বলি। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায়নি।’’ তাঁদের আশঙ্কা, ওই জায়গায় বেশ কিছু আম-নিমের গাছ রয়েছে। আততায়ীরা সম্ভবত, সেখানেই দেহ ঝোলানোর তালে ছিল। গোলমাল বুঝে পালিয়ে যায়। কৃষ্ণপদ, দীনবন্ধুর দাবি, পুলিশ-কুকুর ঘটনাস্থলে দুলালের দেহ শোঁকার পরে ঘুরতে ঘুরতে আম-নিমের গাছের কাছে থাকা একটি পুকুর পর্যন্ত এসেছিল।

সুপুরডিতে ত্রিলোচনের বাড়ির সামনের মাচায় এ দিন দুপুরে ঘুমাচ্ছিলেন কিছু যুবক। তাঁদের মধ্যে বিষ্ণুপদ মাহাতো, কর্ণ মাহাতোরা বলেন, ‘‘রাত পাহারা চলছে বলে দুপুরে ঘুমাচ্ছি।’’ তাঁদের আলোচনাতেও ঘুরেফিরে গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ত্রিলোচনের রহস্যজনক মৃত্যুর খবরই এসেছে।

ত্রিলোচনের মেজদা শিবনাথ জানান, ভোটের দিন ত্রিলোচনের সঙ্গে গ্রামের যে ছ’জনের বিরুদ্ধে ঝগড়ার অভিযোগ করেছিলেন, দেখে নেবে হুমকি দিয়েছিল। শিবনাথ বলেন, ‘‘আমি বলরামপুর বাজারে একটি সার-বীজের দোকানে কাজ করি। ভাইকে যে দিন ওরা তুলে নিয়ে গেল, সে দিন ওই ছ’জনের মধ্যে এক জনকে কয়েকবার দোকানের আশপাশে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, এখন মনে হনে হচ্ছে, ওরা নজর রাখার চেষ্টা করছিল। হয়তো আমাকে টার্গেট করেছিল।’’

বলরামপুরের বজরং দলের নেতা বিরিঞ্চি কুমার অভিযোগ করেন, ‘‘মানুষ তৃণমূলকে এনেছিল, গরিবের ভাল হবে ভেবে। কিন্তু, তৃণমূলের দুর্নীতিই বিজেপির উত্থানের প্রধান কারণ। দু’টি মৃত্যু নিয়ে বিজেপি যা অভিযোগ করছে, তা ঠিক। সিবিআই তদন্ত হলেই প্রকৃত সত্য সামনে আসবে।’’ শিবনাথ জানান, আগামী সপ্তাহে তাঁরা কলকাতায় হাইকোটে সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলা করার কথা ভাবছেন। তার আগে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের পুরুলিয়ায় আসার কথা। তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘জঙ্গমহলের যে উন্নতি হয়েছে, তা সবাই জানেন। শুধু মিথ্যা বলার জন্যই বিরোধীরা দুর্নামের চেষ্টা করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE