Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দাদা, তোকে গুলতি দিব

পাকা সড়কের দু’ধারে পদ্ম-বোনা পুকুর। ইতিউতি শালুক, জল মাকড়সার সাঁতার। ভাঙা ডালে আশ্বিন রোদে ডানা শুকোচ্ছে নিঃসঙ্গ পানকৌড়ি।

পদ্মে ঢেকেছে পুকুর। —নিজস্ব চিত্র।

পদ্মে ঢেকেছে পুকুর। —নিজস্ব চিত্র।

রাহুল রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:২২
Share: Save:

পাকা সড়কের দু’ধারে পদ্ম-বোনা পুকুর। ইতিউতি শালুক, জল মাকড়সার সাঁতার। ভাঙা ডালে আশ্বিন রোদে ডানা শুকোচ্ছে নিঃসঙ্গ পানকৌড়ি।

তাপ্পি মারা টিউবটা কাঁধে ঝুলিয়ে পুকুর বাছাইয়ে বেরোয় বিলু। সুপুরের জলায় বিকেল পর্যন্ত ভেসে ভেসে তেত্রিশটা প্রাণ-পদ্ম তোলার পরেও রমানাথের কাছে এক চোট ধাতানি খেয়েছে সে, ‘দিনভর জল দাপিয়ে মাত্তর এই ক’টা ফুল লইয়া এলি, শালো!’

পদ্ম কাঁটার খোঁচা বাঁচিয়ে ফুল তুললেই তো হল না, হ্যাঁচকা টান দিলেই তার সঙ্গে উঠে আসা শাপলা-দল, সে সব ছাড়িয়ে সন্তর্পণে ফুলটা দু’আঙুলের ফাঁকে গুঁজে ফের ভেসে পড়তে হয়— কে বোঝাবে রমানাথকে?

ডালডার টিন দিয়ে গত বার যে ডোঙাটা তৈরি করেছিল পলু, গোয়াল ঘরের পিছনে আলের গজাল থেকে এখনও ঝুলছে সেটা। সবুজ টিনে বর্ষার ঝাপটায় মর্চে ধরেছে, বিলু আড়চোখে ডোঙাটার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। নাহ্, ওটা দাদারই থাক। ডোঙার গায়ে দু’টো গাঙফড়িং স্মৃতির মতো ভেসে আছে, বসছে আবার উড়ে যাচ্ছে। পদ্ম তোলার রেষারেষিতে পলুর সঙ্গে ঝগড়া তো কম হয়নি, হাতাহাতিও। ও ডোঙায় আর হাত দেবে না সে।

আউশগ্রামের মোড়ে শিবের সাইকেল সারাইয়ের এক ফালি দোকান। ফাটা টিউবটা সেখান থেকেই জোগাড় করে নিয়েছে বিলু। খান কয়েক তাপ্পি মেরে গোয়ালের কালো পোয়াতি গাইটার পেটের মতো খানিক ফুলিয়ে পদ্ম-পুকুরে ভেসে পড়েছে। ঘন জলায় মুখটুকু ভাসিয়ে রাখার সময়ে এখনও হঠাৎ হঠাৎ দাদার সঙ্গে সেই সব ঝগড়ার বিকেলগুলো মনে পড়ে যায় বিলুর। মনে মনে আওড়ে নেয়, এ বার আর কোনও প্রতিপক্ষ নেই। দাদার সঙ্গে মন কষাকষিটা দাসপাড়ার শ্মশানে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার পরে বিলু এ বছর একা, হ্যাঁ এক্কেবারে একাই তো!

টিউব কাঁধে খিড়কি দিয়ে বেরনোর মুখে ধরা পড়ে যায় সে, ‘‘গত পুজোয় একটা গেল, এ বার তুই যা....পোড়া কপাল আমার!’’ বিলু জানে উঠোনময় উন্মাদের মতো দাপিয়ে চুপ করে যাবে মা। সে বার যেমন পা দু’খানা দু’বার ধড়াস ধড়াস করে দাপিয়ে একেবারে চুপ করে গিয়েছিল দাদা।
এ বার, রায়দের মণ্ডপের সামনে ষষ্টীর বিকেল থেকে যে উলোঝুলো মেলাটা বসে, সেখান থেকে একটা রবারের গুলতি কিনবে সে। তার পর, ওই ঝোলানো ডোঙাটার পাশে সুযোগ বুঝে ঝুলিয়ে দেবে।
আসরাফদের সঙ্গে ঘুঘু শিকারে গিয়ে গত বছর দাদার গুলতিটা ফর্দাফাঁই করেছিল বিলু। এক চোট হাতাহাতিও হয়ে গিয়েছিল খুব। পলু বলেছিল, ‘আমার জিনিসে ই বার হাত দিল্যা না আঙুল কাইটব।’ তা হোক, মণ্ডলদের পুকুর থেকে দাদাকে সবাই যখন ধরাধরি করে নিয়ে এল, বিলু তখনই ঠিক করে নিয়েছিল, ‘সেইরে ওঠ, তুয়ার গুলতিখানাও ফিরত দিয়া দিব...!’
মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সাহাদের খামারবাড়ি ছাড়িয়ে কখন যে ঘোষপাড়ার মাঠে এসে পড়েছে, খেয়ালই করেনি বিলু। ‘‘হেই দেখ, গত পুজায়, দাদাকে সাপে কাটল মোড়লদের এই পুকুরে, আর তুই কিনা পদ্মের খোঁজে সেইখানেই এলি...’’ গাঁয়ের সমীরণ কাকা, বগলে ছাতা নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে। বিলু স্থির চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘‘যত্তোসব’’, হন হন করে সরে যায় ছায়াটা, হুঁশ ফেরে বিলুর। খেয়ালই করেনি, ধুলো মাখা চোরা রাস্তাটা ধরে আনমনে কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে মণ্ডলদের সেই গহীন পুকুরটার কিনারে, অজস্র ভ্রমর, গাব গাছের আড়ালে এক টানা কুবো ডাকছে। টিনের ডোঙা নিয়ে এ সব ঘন পুকুরেই ভেসে বেড়াত পলুটা।
সেই পুকুরের কোলে দাঁড়িয়ে পাক্কা এক বছর পরে তার মনে হচ্ছে, মণ্ডল পুকুরের কালো জল বড় ঘন, স্মৃতিভারাতুর। তার চোখের পাতা বট ফলের মতো ভারী হয়ে আসে। ছবির মতো সরে যেতে যেতে গেল বছরের একটা দুপুরের কিনারে এসে দাঁড়ায় বিলু— জল উথাল পাথাল করে দু’ভাই পদ্ম তুলছে...
পলু জিজ্ঞেস করে, ‘কয়টা তুললি?’
ছোট্ট একটা কুলকুচি ছুঁড়ে দাদার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয় বিলু —‘বিশ-বাইশটা, তর শুনি?’
—জইল টো বড় ঠান্ডা রে দাদা, চল উঠে পড়ি পলু রা কাড়ে না...
বুনো শোল ঘাই মারে, ডানা ঝাপটে উড়ে যায় মাছরাঙা, দাদা কথা কয় না কেন? কিছু কি হল?
মাথা হেলিয়ে বিলু এক বার দেখার চেষ্টা করে... ঘন পদ্ম ঢাকা পুকুরটা যেন চুপ করে কিছু বলছে! হঠাৎ চোখে পড়ে, পদ্ম পাতার উপরে হাতটা উঠেই তলিয়ে গেল, কার হাত? জল-রোদ্দুরের কাটাকুটিতে ভুল দেখল কি...চিলের মতো চিৎকারটা ভেসে এল তখনই...‘বিলুরে সাপে কাইটছ্যা!’ দুপুর ছেঁড়া সেই মরণ ডাকে যেন চমকে উঠে পুকুর পাড় থেকে উ়ড়ে যায় এক ঝাঁক ফিঙে। মুখটা জলের উপর আপ্রাণ তুলে ধরে বিলু, চোখে পড়ে, পলুর ছটফট করা হাতের কোল ঘেঁষে পুকুরে বিলি কেটে হারিয়ে যাচ্ছে এক গোখরো।
কনুইয়ের কাছে বেড়ি পড়ল তার, ঠোঁটের কোণে জমা গ্যাঁজলা মুছিয়ে দিল কেউ, তার পর, দাদার পাঁজকোলা শরীরটা চলল বাড়ির দিকে। ‘তুই কী করছিলি’, হাঁউমাউ করে বিলুর পিঠে দুম দুম করে দু’ঘা বসিয়ে দিল মা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা বিলুর চোখের সামনে ধড়াস ধড়াস করে পা দাপাচ্ছে দাদা।
সেই ভিড়েই মাথা গলিয়ে শেষ বারের মতো পলুকে দেখেছিল সে, দাদার মাথার কাছে বসে, ভেজা চুলে বিলি কাটছে মা, আর আওড়ে চলেছে, ‘‘অ পলু, এখনই চইল্যা যাবি, আজ যে পঞ্চমী বাবা...’ তার ১২ বছরের জীবনে প্রথম বার কেউ ঘর-বাড়ি-ভালবাসা ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। এক ছুটে সেখান থেকে চলে এসেছিল বিলু। সেই মোড়ল পুকুরের কোলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বিলু, মনে মনে বলে, ‘দাদা, তোরে একটা গুলতি কিনা দিব, আর ঝইগর‌্যা করব না, পাক্কা...’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga pujo Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE