ইডি অফিসে শুভাপ্রসন্ন। সোমবার। ছবি: শৌভিক দে।
পাঁচ মাস আগে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সংস্থার দরদাম নিয়ে ধন্দ কাটানোর চেষ্টা করেছিল ইডি। সোমবার শুভাপ্রসন্নকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সেই ধন্দের সঙ্গে যোগ হল সংস্থার হাতবদল নিয়ে ধোঁয়াশাও। এ দিন তাঁকে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে বেলা ১১টা থেকে সওয়া পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ইডি সূত্রের খবর, শুভাপ্রসন্ন তাঁর সংস্থার হাতবদল নিয়ে অনেক প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেননি এ দিন। যে কারণে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই চিত্রশিল্পীকে ফের তলব করা হতে পারে বলে এ দিনই জানিয়েছেন ইডি-র তদন্তকারীরা।
পরনে মেরুন ফিনফিনে পাঞ্জাবি, কালো পাজামা। গাড়ি থেকে নেমে শুভাপ্রসন্ন এ দিন সোজা ঢুকে যান সিজিও কমপ্লেক্সে। সংবাদমাধ্যমের কোনও প্রশ্নের উত্তর দেননি। বিকেল সওয়া চারটের সময় বেরিয়েও মুখ গোমড়া করে গাড়িতে উঠে যান তিনি। রাতে তদন্তকারীদের একাংশের বক্তব্য, অনেক প্রশ্নের উত্তরই এড়িয়ে যাচ্ছেন শুভাপ্রসন্ন। কিছু ক্ষেত্রে অসহযোগিতাও করছেন। বারবার অসহযোগিতা করা সত্ত্বেও শুভাপ্রসন্নর বিরুদ্ধে কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটছে না কেন ইডি? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি তদন্তকারীদের কাছ থেকে।
ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধীকেও এ দিন ইডি দফতরে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় অসমে সারদা গোষ্ঠীর একটি পত্রিকার এক কর্মীকেও। তাতেই সারদার এক কর্তার বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে কিছু সূত্র মিলেছে বলে ইডি-র দাবি। তবে শুভাপ্রসন্নর সংস্থার হাতবদল ও হিসেবের জট নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় ইডি।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, ২০০৬ সালে শুভাপ্রসন্ন ‘দেবকৃপা ব্যাপার’ নামে একটি শেয়ার কেনাবেচার সংস্থা কিনেছিলেন। পরে সেটি সংবাদমাধ্যম ব্যবসায় চলে আসে। ‘এখন সময়’ নামে একটি খবরের চ্যানেল তৈরির কাজও করছিলেন শুভাপ্রসন্ন। কিন্তু ২০১১ সালে হঠাৎই তিনি ওই চ্যানেল-সহ সংস্থাটিকে সারদার কাছে বিক্রি করে দেন। সেই সূত্রেই সারদা কেলেঙ্কারিতে তাঁকে তলব করেছে ইডি। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে এই শিল্পীকে ডেকেছে সিবিআইও।
এ দিন কী জিজ্ঞাসা করা হয়েছে শুভাপ্রসন্নকে?
ইডি সূত্রের খবর, সংস্থা বিক্রি করার পরেও কেন শুভাপ্রসন্ন ওই সংস্থার ডিরেক্টর পদে রইলেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। শুভাপ্রসন্ন এ দিন একটি চিঠি তদন্তকারীদের কাছে জমা দেন। ২০১১ সালের ৭ নভেম্বরের ওই চিঠিতে দেবকৃপার সব কাগজপত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করেছেন সুদীপ্ত সেন। তদন্তকারীদের প্রশ্ন, ২০১১ সালের নভেম্বরে সুদীপ্ত সেন কাগজ বুঝে পেলেন। অর্থাৎ, সংস্থার মালিকানা বদল হল। সংস্থার মালিক হল সারদা। কিন্তু কোম্পানি নিবন্ধকের (আরওসি) নথি বলছে, দেবকৃপার ডিরেক্টর হিসেবে সুদীপ্ত সেন ও দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের নিয়োগের তারিখ ২০১২ সালের ৯ জুলাই। মাঝের আট মাস তবে কে দেখতেন সংস্থার যাবতীয় কাজকর্ম? এই ক’মাস সংস্থার ডিরেক্টরই বা কে ছিলেন? এর কোনও উত্তর শুভাপ্রসন্নবাবু দিতে পারেননি বলে ইডি সূত্রের দাবি।
ইডি কর্তারা বলছেন, সংস্থা বিক্রি করার পরেও শিল্পী ও তাঁর স্ত্রীর নাম ডিরেক্টরদের তালিকায় ছিল। সংস্থার স্বীকৃত স্বাক্ষরকারীর (সিগনেটরি) হিসেবে এখনও তাঁদের নাম রয়েছে। এখানেই দেবকৃপার সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্ক নিয়ে রহস্য দানা বেঁধেছে বলে ইডি-র দাবি।
দেবকৃপার হিসেবের গোলমাল নিয়েও এ দিন ফের প্রশ্ন করা হয় শুভাপ্রসন্নকে। গত ১৩ অক্টোবর তিনি ইডি-র জিজ্ঞাসাবাদের সময় দাবি করেছিলেন, দেবকৃপা বিক্রি করে ৬.৫ কোটি টাকা পেয়েছিলেন। অথচ সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে রাজ্য পুলিশ জানিয়েছিল, দেবকৃপার পিছনে সুদীপ্ত সেনের ১৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল।
এই ফারাকটা কেন? বাকি টাকা তবে গেল কোথায়? এটা জানতেই শুভাপ্রসন্নকে ইডি দফতরে হাজির হওয়ার নোটিস পাঠানো হয় গত নভেম্বরে। শুভাপ্রসন্ন এর পরে বেশ কিছু নথি ইডি-র কাছে পাঠান তাঁর এক সহকারীকে দিয়ে। ইডি কর্তারা জানাচ্ছেন, সেই নথি ঘেঁটেও সংস্থা বিক্রির টাকা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।
ইডি-র এক তদন্তকারী জানান, সুদীপ্ত সেনের বয়ান বলছে, সংস্থাটি বিক্রি করা হয়েছিল ১০ কোটি টাকায়। চ্যানেল তৈরির সময় বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিল দেবকৃপা। সুদীপ্তর দাবি, চ্যানেল-সহ সংস্থাটি কেনার সময় ওই দেনা শোধ করতে ৩.৫ কোটি খরচ হয়েছিল। আর অংশীদাররা ভাগ করে নিয়েছিলেন ৩ কোটি টাকা। শুভাপ্রসন্নও ৬.৫ কোটি টাকা পাওয়ার কথাই জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ ছাড়াও চ্যানেলের যন্ত্রাংশ বাবদ ৩.৫ কোটি টাকা খরচের কথাও সুদীপ্ত তাঁর বয়ানে উল্লেখ করেছেন। সেটা যোগ করলে তবেই অঙ্কটা ১০ কোটিতে পৌঁছয়। ইডি-র কাছে প্রশ্ন, কে ঠিক বলছেন? শুভাপ্রসন্ন না সুদীপ্ত? দেনা শোধই হোক বা যন্ত্রাংশের খরচ, আদতে কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে, সে সবও অন্যান্য সূত্র থেকে যাচাই করছে ইডি।
এর পরেও প্রশ্ন থাকছে, রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) তবে কী ভাবে সংস্থাটি বিক্রি বাবদ ১৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা জমা দিল?
বাকি ৪ কোটি টাকা নিয়ে সম্ভাব্য একটি ব্যাখ্যার কথাও মাথায় রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ইডি-র এক কর্তা। তা হল, চ্যানেল কেনার পরে তার কর্মীদের বেতন দিতে ও অন্যান্য খাতে ৪ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন বলে সুদীপ্ত সেন দাবি করেছিলেন।
ইডি-র সামনে এখন তাই প্রশ্ন, সিটের তদন্তেই কি কোনও ফাঁক ছিল? নাকি সুদীপ্ত সেন বা শুভাপ্রসন্ন ঠিক তথ্য জানাচ্ছেন না? এ সবের উত্তর খুঁজতেই ইডি ফের ডেকে পাঠাতে পারে শুভাপ্রসন্নকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy