Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

আর মার খাব না, ৭৮ পেরিয়ে সহ্যের সীমা ভেঙে স্বামীর বিরুদ্ধে লড়াই

সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন-সহ ই এম বাইপাসের হাসপাতালে বৃদ্ধাকে ভর্তি করেছিলেন তাঁর ৮০ পেরোনো স্বামী। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরে আর স্বামীর সঙ্গে ফেরেননি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৯ ০৪:০১
Share: Save:

ঘুরে দাঁড়ানোর বয়স থাকে না।

৭৮ পেরোনোর পরে, আইসিইউ-এর শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে যুঝতেও কেউ বলে উঠতে পারেন, ‘‘আর পড়ে পড়ে মার খাব না। নিজের জীবনটা এ বার নিজের মতো করেই কাটাব।’’ চোখরাঙানি, চিকিৎসার দায়িত্ব না নেওয়ার হুমকি, এমনকি, আবেগের খোঁচাতেও সিদ্ধান্ত বদলাননি তিনি।

সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন-সহ ই এম বাইপাসের হাসপাতালে বৃদ্ধাকে ভর্তি করেছিলেন তাঁর ৮০ পেরোনো স্বামী। হাসপাতাল থেকে ছুটি পাওয়ার পরে আর স্বামীর সঙ্গে ফেরেননি। মেয়েদের হাত ধরে পৌঁছেছেন এক বৃদ্ধাবাসে। জানিয়েছেন, সেখানেই কাটবে তাঁর জীবনের বাকি সময়।

তার আগে সল্টলেকে মহিলা কমিশনের দফতর থেকে প্রতিনিধিরা গিয়েছিলেন ওই হাসপাতালে। বৃদ্ধার দুই মেয়ে মায়ের নিরাপত্তার জন্য কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, সচ্ছল, অভিজাত পরিবারের, উচ্চশিক্ষিত ওই বৃদ্ধার উপরে শারীরিক অত্যাচার চালান তাঁদের বাবা। আশৈশব সেটাই দেখে আসছেন তাঁরা। মা বরাবর সহ্য করেছেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেষ হয়েছে। বিয়ে করেছেন তাঁরা। কিন্তু মায়ের অবস্থা বদলায়নি। মেয়েরা নিয়ে যেতে চাইলেও রাজি হননি বৃদ্ধা। তবে তাঁর সহ্যের সব বাঁধ ভেঙেছে সম্প্রতি।

কিডনির অসুখে আক্রান্ত ওই বৃদ্ধার নিয়মিত ডায়ালিসিস চলে। সম্প্রতি স্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। অভিযোগ, সেই অবস্থাতেও ডাক্তার ডাকার আগে তাঁকে মারধর করেন স্বামী। পরে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় নিয়ে যান একটি বেসরকারি হাসপাতালে। দুই মেয়ের একজন থাকেন ইংল্যান্ডে। অন্য জন মুম্বইয়ে। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁরা আসেন কলকাতায়। তার পর মায়ের অনুমতি নিয়ে দ্বারস্থ হন রাজ্য মহিলা কমিশনের। কমিশন হাসপাতালে গিয়ে বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি ডেকে পাঠায় তাঁর স্বামীকেও। যদিও বৃদ্ধ চোটপাট শুরু করেন। বলেন, ‘‘কথা না শুনলে মারি। এটা আবার অত্যাচার হল নাকি? এখন আপনারা এগুলোকে অত্যাচার বলেন। আগে এগুলো ঘরোয়া ব্যাপারই ছিল। এ জন্য কারও ঘর ভাঙত না।’’

শুধু তাই নয়, স্ত্রী তাঁর সঙ্গে থাকতে চান না জেনে ওই বৃদ্ধ চিকিৎসার খরচ বন্ধ করে দেওয়ারও হুমকি দেন। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ওই বৃদ্ধ পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বড় সংস্থায় চাকরি করতেন। নিজের এবং স্ত্রীর চিকিৎসার যাবতীয় খরচ এখনও তিনি পুরনো অফিস থেকেই পান। তা সত্ত্বেও খরচ না দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলে‌ন। কমিশনের তরফে ওঁর অফিসেও চিঠি দেওয়া হয়। শেষে বৃদ্ধ হুমকি দেন, হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর ছুটির সময়ে কোনও কাগজেই সই করবেন না। যে হেতু হাসপাতালে তিনি ভর্তি করিয়েছিলেন, তাই তাঁর সই জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত কমিশনের হস্তক্ষেপে তিনি সই করেন।

লীনাদেবীর কথায়, ‘‘এক সময়ে অত্যাচার সহ্য করেছেন বলে আজীবন সেটাই করে যাবেন, তা নয়। মানুষ চাইলে যে কোনও সময়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। এই ঘটনা তারই প্রমাণ।’’ এত দিন পরে কেন রুখে দাঁড়ানোর কথা মনে হল? বৃদ্ধার জবাব, ‘‘ওই স্ট্রোকটাই আমার নবজন্ম বলতে পারেন। মরেই তো যাচ্ছিলাম। বেঁচে গিয়ে মনে হল, জীবনটা খুব দামি। প্রতি মুহূর্তে তাকে এত অসম্মান করা যায় না।’’

মেয়েরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান না তাঁরা। মাকে এ বারও নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বৃদ্ধা যাননি। মেয়েদের ব্যবস্থাপনাতেই দক্ষিণ কলকাতার এক বৃদ্ধাবাসে আপাতত রয়েছেন। পুলিশের কাছেও যাননি। জানিয়েছেন, আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে নিজের ক্লান্তি আর বাড়াতে চান না। তাঁর কথায়, ‘‘এ বার নিজের মতো করে বাঁচার ইচ্ছা হয়েছে। দেখা যাক, জীবন কত দিন আমাকে সেই সুযোগ দেয়।’’

কিন্তু অপরাধী তো শাস্তি পেল না? বৃদ্ধার জবাব, ‘‘শেষ বয়সে একা হয়ে যাওয়া! এটাও কি যথেষ্ট শাস্তি নয়?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Salt Lake Women Commission Torture Old Age Home
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE