Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কুসংস্কার চলবে না, প্রতিবাদেই রক্ষা প্রৌঢ়ার

জানগুরু নিদান দিয়েছেন। তাই এক দল আদিবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির ফুলমণি হাঁসদার বাড়ি। তিনি নাকি ‘ডাইনি’! বছর আটান্নর প্রৌঢ়া তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু কে শোনে! হঠাৎই তেড়ে এলেন গ্রামের চার আদিবাসী যুবক। সঙ্গে হুঙ্কার— ‘এ সব কুসংস্কার চলবেক নাই’।

পীষূষ নন্দী
গোঘাট শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৩
Share: Save:

জানগুরু নিদান দিয়েছেন। তাই এক দল আদিবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির ফুলমণি হাঁসদার বাড়ি। তিনি নাকি ‘ডাইনি’! বছর আটান্নর প্রৌঢ়া তখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু কে শোনে! হঠাৎই তেড়ে এলেন গ্রামের চার আদিবাসী যুবক। সঙ্গে হুঙ্কার— ‘এ সব কুসংস্কার চলবেক নাই’।

মঙ্গলবার সকালে গোঘাটের খাটগ্রামের আদিবাসীপাড়ায় যখন ওই হামলার চেষ্টা হচ্ছিল, তখন নিজেদের সম্প্রদায় থেকেই এমন প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা থতমত। তার মধ্যেই ওই যুবকদের নির্দেশ, যে ‘অসুস্থ’ যুবতীর দাবিতে ওই প্রৌঢ়াকে ‘ডাইনি’ ঘোষণা এবং এত কাণ্ড তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওই যুবকদের ডাকে এল পুলিশ। এলেন প্রশাসনের কর্তারা। ঘাবড়ে গিয়ে প্রশাসনের কাছে ক্ষমা চাইল মারমুখী গ্রামবাসী। রক্ষা পেলেন ফুলমণি। একই সঙ্গে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে উদ্বুদ্ধ হল আশপাশের গ্রামও।

২৮টি দিনমজুর পরিবারকে নিয়ে খাটগ্রামের আদিবাসীপাড়া। যার এক দিকে সাতগাছিয়ায় ২০১৪-এ কিছু গরুর মৃত্যুতে বৈদ্যনাথ সরেন এবং শুকচাঁদ সরেন নামে দুই ভাইকে ডাইন অপবাদ দিয়ে মারধর করা হয়। গত বছর ফের পাশের বিজলকোনা গ্রামের কুবিরবেড়ে আদিবাসীপাড়ায় জন্ডিস আক্রান্ত এক বালিকার মৃত্যুতে নীলমণি মুর্মু নামে এক বৃদ্ধাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পেটানো হয়। তখন কোনও প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু খাটগ্রামে শোনা গেল প্রতিবাদ।

যাঁদের জন্য ফুলমণি রক্ষা পেলেন, সেই মনোরঞ্জন হাঁসদা, বিনোদ মাণ্ডি, মালিক হাঁসদা এবং রবীন্দ্রনাথ হাঁসদা পেশায় দিনমজুর কেউ ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। কেউ অষ্টম। প্রতিবাদ করতে শিখলেন কী করে? তাঁরা জানান, খবরের কাগজ, টিভি থেকে তাঁরা জেনেছেন এ সব অন্যায়। মনোরঞ্জনের কথায়, ‘‘গ্রামে শিবির ছাড়াও বিভিন্ন মেলা ও বিজ্ঞান মঞ্চের অনুষ্ঠানেও এ সব নিয়ে প্রচুর প্রচার হয়।’’ বিনোদ বলেন, “ডাইনি নিয়ে পাড়ার যাতে বদনাম না হয়, কাউকে যাতে ছোট করা না হয় সে বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা।” রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘এলাকায় কোনও সালিশি সভাও যাতে না হয়, তার চেষ্টা করা হবে। সমাজের প্রথার কথা ভেবে যাঁরা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, বোঝানোর পরে তাঁরা সকলেই অনুতপ্ত।”

চার আদিবাসী যুবকের সাহসকে কুর্নিশ করেছে প্রশাসনও। ভারপ্রাপ্ত মহকুমাশাসক (আরামবাগ) দেবজ্যোতি বসু বলেন, “জেলায় কুসংস্কার বিরোধী এবং যুক্তিবাদী মন গড়ার লক্ষ্যে ফের শিবির করা হবে।’’ আর ফুলমণি বলছেন, ‘‘ওঁদের জন্য বাঁচলাম। যাক, শেষমেশ প্রতিবেশীদের শুভবুদ্ধি হয়েছে।’’

কী হয়েছিল মঙ্গলবার? সূত্রের খবর, বাঁকুড়ার ইন্দাসের ২২ বছরের বাসিন্দা রূপা মুর্মু খাটগ্রামে তাঁর পিসেমশাইয়ের বাড়িতে থাকেন। রূপার দাবি, দিন দশেক ধরে তিনি স্বপ্নে ভয়ঙ্কর জীবজন্তু দেখছিলেন। তার সঙ্গে প্রতিবেশী ফুলমণিদেবীর মুখও দেখেন এবং তার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন বলে তিনি গ্রামবাসীদের জানান। গত সোমবার রাতে রূপাকে নিয়ে তাঁর আত্মীয় ও কয়েকজন পড়শি বাঁকুড়ার পুনিয়া গ্রামে জানগুরুর কাছে যান। তাঁদের দাবি, জানগুরু ফুলমণিকে ‘ডাইনি’ চিহ্নিত করেন। এরপরেই মঙ্গলবার সকালে প্রতিবেশীদের সব জানিয়ে রূপার বাড়ির লোকজন ফুলমণির বাড়িতে চড়াও হন। গ্রামবাসীরাও তাতে সামিল হন। খবর পেয়ে সেখানে হাজির হন মনোরঞ্জনরা।

বুধবার অবশ্য খাটগ্রাম ছিল অন্য দিনের মতোই স্বাভাবিক। ভিড় দেখা গেল এলাকার মনসামাতা ক্লাবে। মনোরঞ্জনরা ওই ক্লাবের সঙ্গেই যুক্ত। সেখানে হাজির বিজলকোনা গ্রামের কুবিরবেড়ে, গয়লাবেড়ে এবং বড়ডাঙা নামে তিনটি আদিবাসী পাড়ার কিছু যুবক। তাঁরাও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতে চান। তাঁদের মধ্যে কুবিরবেড়ে পাড়ার বিমল মুর্মু বলেন, ‘‘আমাদের এলাকাতেও ডাইনি কুসংস্কার রয়েছে। বেশ কয়েকবার শিবিরও হয়েছে। খাটগ্রাম রাস্তা দেখাল, এ বার আমরাও পারব।’’

এই সবের মধ্যেই অবশ্য রূপা যেন কিছুটা লজ্জিত! কারণ আজ তাঁর স্বপ্নের জন্যই ফুলমণিকে ‘ডাইনি’ চিহ্নিত করা হয়েছিল! তিনি বলেন, ‘‘কেন ও সব প্রসঙ্গ তুলছে? সব মিটে গিয়েছে। আর কোনও খারাপ স্বপ্ন দেখিনি।”

ঠিকই। আদিবাসীপাড়া নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। যার বীজ বুনেছেন মনোরঞ্জনরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Elderly woman Protest Superstition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE