এখানেই কি লেগেছে? বাইসনের শিঙের গুঁতোয় জখম কুনকি হাতি করণরাজের দেখভাল করছেন বন দফতরের চিকিৎসক। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।
দুলকি চালে দিব্যি চলছিল করণরাজ। পিঠে সওয়ার হয়ে দুলুনিটা মন্দ লাগছিল না।
কালীপুর ইকো-ভিলেজ থেকে মেদলায় এসে হাতির পিঠে সওয়ার হয়েছিলেন কলকাতার জনাকয়েক পর্যটক। শনিবার সকাল ছ’টা। তিনটি হাতিতে তিন জন করে সওয়ার ৯’জন। সেই হাতিরই একটি করণরাজ। গরুমারার প্রশিক্ষিত কুনকি হাতি। মেদলা নজরমিনারের পাশ দিয়ে শেষ জৈষ্ঠ্যের মূর্তি নদী (মঝেমধ্যেই বৃষ্টি হওয়ায় নদীতে ভালই স্রোতের টান) পেরিয়ে হাতির দল সবে ঘাসবনে পা রেখেছে!
এক মানুষ লম্বা ঘাসের মধ্যে গিয়ে সন্ধানী চোখ খুঁজে নিতে চাইছিল গরুমারার বিখ্যাত হাতি, বাইসন, গন্ডারকে। তাদের দেখা মিলবেই, এমনটা তো গরুমারায় ঢুকে হলফ করে বলা যায় না। তবু, গরুমারার জঙ্গলে ঢোকা যে কোনও পর্যটকই সেই আশায় থাকেন। আর সেই আশা যে এত দ্রুত পূরণ হবে, তা ভাবতে পারেননি ওঁরা। যেমন ভাবতে পারেননি, তার পরবর্তী ঘটনাক্রমও।
ঘাসবনে ঢোকার কিছু পরেই চোখে এল বাদামি রংয়ের বিশাল চেহারাটা। ঘাসে ঢাকা। পুরোটা দেখা যাচ্ছিল না। করণরাজকে দ্রুত সে দিকে নিয়ে গেলেন মাহুত। আর তখনই ঘটে গেল বিপত্তি! কেউ কিছু বঝে ওঠার আগেই বাইসন তেড়ে এল করণরাজের দিকে। ‘ডিফেন্স’ নেওয়ার আগেই হাতিকে সজোরে ধাক্কা! তার পরেই শিংয়ের রামগুঁতো করণরাজের শুঁড়ে। ছোটখাটো চেহারার কুনকি তখন দিশাহারা। ভয় পেয়ে হাতি ছুটতে শুরু করল উদভ্রান্ত হয়ে। আর তার পিঠ থেকে সটান পড়ে গেলেন বছর পঞ্চাশেকের এক পর্যটক। পিঠে প্রচণ্ড চোট লেগেছে। কোনও রকমে যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন ধারেপাশে আর তার হাতি নেই। নাম না প্রকাশ করার শর্তে ওই পর্যটক বললেন, ‘‘বয়স হয়েছে তো। হাতির পিঠ থেকে হঠাৎ ওই ভাবে পড়ে যাওয়ায় পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম। মাথার সমান ঘাস। চারপাশে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।’’
করণরাজ তখনও ছুটছে। তার পিঠে থাকা দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। আর মাহুত আপ্রাণ চেষ্টা করেও হাতিকে বাগে আনতে পারছে না। অনেকটা যাওয়ার পরে অবশ্য মাহুতই জিতলেন। করণরাজকে ফের ফিরিয়ে আনা হল ওই জায়গায়। পড়ে যাওয়া পর্যটককে তুলে নেওয়া হল। তাঁর কথায়, ‘‘সব মিলিয়ে হয়তো পাঁচ মিনিটের কিছু বেশি সময় ছিলাম সেখানে। কিন্তু, সেটাই মনে হচ্ছিল পাঁচ ঘণ্টা!’’ সেই বাইসন তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে ওখানেই। বোনাস হিসাবে পর্যটকদের প্রাপ্তি হল তিনটি গন্ডারের দেখা পাওয়া।
এই ঘটনার পরে গরুমারা, চাপড়ামারি-সহ গোটা উত্তরবঙ্গে হাতি-সাফারিতে নিরাপত্তা আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, অন্য প্রতিটি জাতীয় উদ্যান কিংবা অভয়ারণ্যে যেখানে হাতি সাফারি চালু রয়েছে, সেখানে কুনকি হাতিদের পিঠে হাওদা বেঁধে তারওপর পর্যটকদের বসানো হলেও গরুমারা জাতীয় উদ্যানেই কেবল মাত্র হাওদা ছাড়াই পর্যটকদের ওঠানো হয়। আর এতেই গভীর অরণ্যের ভিতরে হাতির পিঠ থেকে পর্যটক পড়ে যাওয়ার মত দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে করেন পরিবেশপ্রেমী থেকে ট্যুর অপারেটর বা স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীরা। করণরাজ যথেষ্ট প্রশিক্ষিত হলেও আচমকা বাইসনের মুখোমুখি পড়েই ঘাবড়ে যায় বলে মাহুত সঞ্জয় শাহের দাবি। তিনি বলেন, ‘‘এখানকার হাতির পিঠে হাওদা থাকে না। তাই আমরা পর্যটকদের হাতির পিঠে বাঁধা দড়ি শক্ত করে ধরে বসতে বলি। এ ক্ষেত্রে হয়তো হাত আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই এক জন পড়ে ’’
লাটাগুড়ি রিসর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দিব্যেন্দু দেব জানান, দড়ি ধরে বসে থাকতে হয় পর্যটকদের। হাতি যদি ভয় পেয়ে সামনের পা উঠিয়ে দেয় বা দৌড়তে শুরু করে তা হলে পর্যটকদের পড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া, জঙ্গলের কোর এরিয়ায় যেখানে গন্ডার, বাইসনের দল থাকে, সেখানে শুধু মাহুতের ভরসায় পর্যটকদের পাঠানোতেও নিরাপত্তার অভাব থেকেই যায়। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন এর মুখপাত্র অনিমেষ বসুর কথায়, ‘‘হাওদা ছাড়া বনের গভীরে পর্যটকদের যাওয়াটা অবশ্যই ঝুঁকির। এ ভাবে জঙ্গলে পর্যটকদের পাঠালে দুর্ঘটনা কিন্তু আবারও ঘটতেই পারে। সে কারণেই তো হাতি সাফারিতে হাওদার ব্যবহার করা হয়।’’
উত্তরবঙ্গের ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন এতোয়ার কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যালও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘হাওদা থাকাটা তো ন্যূনতম চাহিদার মধ্যেই পড়ে। কেন হাওদা গরুমারার হাতি সাফারিতে থাকে না, তা নিয়েই আমরা অবাক। দ্রুত নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে কিন্তু গরুমারার হাতি সাফারির প্রতি বিরূপ প্রভাবই পড়বে।’’
জলপাইগুড়ি বন্যপ্রাণ ২ বিভাগের ডিএফও সুমিতা ঘটক বলেন, ‘‘গরুমারায় যে কুনকি হাতিদের পর্যটকদের ঘোরাতে ব্যবহার করা হয়, তারা আকৃতিতে বড় নয়। হাওদা লাগাতে সমস্যা হবে বলেই আমরা হাওদার ব্যবহার করতে পারি না। এই ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। তবে ঘটনার পরে মাহুতদের সতর্ক করা হয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়টি আমরাও খতিয়ে দেখছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy