Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গৌতমের হাত ধরে ফিরল বিরলতম তালিপাম

এ যেন ফিনিক্স পাখির গল্পের মতো। পাখি নয়, গাছের নবজন্ম! গাছের নাম ‘তালিপাম।’একশো বছরে একবারই ফুল হয় সে গাছের। তাই ফুলের নাম ‘মরণফুল!’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি, বছর চারেক আগেও বিশ্বের একমাত্র তালিপামগাছটি ছিল তাঁদেরই ক্যাম্পাসে।

বড় হলে যেমন দেখতে হয় তালিপাম।

বড় হলে যেমন দেখতে হয় তালিপাম।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০১:৪৫
Share: Save:

এ যেন ফিনিক্স পাখির গল্পের মতো। পাখি নয়, গাছের নবজন্ম! গাছের নাম ‘তালিপাম।’

একশো বছরে একবারই ফুল হয় সে গাছের। তাই ফুলের নাম ‘মরণফুল!’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি, বছর চারেক আগেও বিশ্বের একমাত্র তালিপামগাছটি ছিল তাঁদেরই ক্যাম্পাসে। সেই গাছে ফুলও ফোটে ২০০৮ সালে। ফুল দিয়ে ২০১০ সালে মারাও যায় সে গাছ! কিন্তু, শেষ পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা প্রায় পাঁচশো চারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যার মধ্যে এখন বেঁচে তিনশো তালিপাম। সম্প্রতি বিরল প্রজাতির গাছই বাংলাদেশ থেকে এল শান্তিনিকেতনে। ও পার থেকে এ পার বাংলায় গাছটি নিয়ে আসার পিছনে প্রধান উদ্যোগ যাঁর, তিনি রামপুরহাট চাতরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উদ্ভিদ-বন্ধু গৌতম রায়।

তিনি জানান, এ গাছের প্রথম আবিষ্কার ১৯১৯-এ। ব্রিটিশ উদ্ভিদবিজ্ঞানী উইলিয়াম রক্সবার্গ এই প্রজাতির গাছের হদিশ পেয়েছিলেন। তিনি সে সময় নাম দেন করিফা তালিয়েরা। ১৯৭৯ সালে বিশ্বভারতীর এলাকা থেকে ওই গাছটি মারা যায়। কথিত আছে, ১৯৭৯ সালে ওই গাছে ফল ও ফুল আসে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষদের একাংশ অশুভ লক্ষণ মেনে কেটে ফেলে ওই গাছ। ২০০১ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তালিপামকে পৃথিবীর সর্বশেষ বন্য তালিপাম হিসেবে চিহ্নিত করেন। গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম করিফা তালিয়েরা (Corypha taliera)। বিলুপ্ত এই উদ্ভিদটি সাধারণভাবে তাল গাছের মতো দেখতে। গাছের চরিত্র মনোকারপিক হওয়ার কারণেই, গাছের জীবন কালে একবার ফুল এবং ফল আসে। তার পরেই গাছটি মারা যায়। সেই গাছ ফিরল শান্তিনিকেতনে। ফেরালেন গৌতমবাবু।

কে এই গৌতম রায়?

বছর পাঁচেক ধরে বিরল গাছের চর্চা করছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা তথা রামপুরহাটের চাতরা স্কুলের এই শিক্ষক। শুধু বিলুপ্তি প্রায় ‘তালিপাম’-ই নয়, ‘খুদে বড়লা’-মতো গাছ নিয়েও কাজকর্ম শুরু করেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তিনি জেনেছেন, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের শিমিলাপাল এলাকায় একটি আছে। এমন গাছ-গাছালিকে ‘এন্ডেমিক টু বাংলা’ বলা হয়। আইইউসিএল-এর ‘রেড লিস্টে’ এই গাছগাছালির কথা উল্লেখ রয়েছে। বিলুপ্ত প্রায় এই গাছগুলিই প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করছেন গৌতমবাবু। শান্তিনিকেতনের সায়রবীথি উদ্যানে এক অনুষ্ঠানে এ দিন বিরল গাছটি দিয়ে গৌতমবাবু বলেন, ‘‘প্রকৃতিপ্রেমী ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় এবং মানেকা গাঁধীর সহযোগিতা না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাছটি এ পারে নিয়ে আসা সহজ ছিল না। তাঁদের কথা বিশেষ ভাবেই বলতে হয়।’’

দীর্ঘ দিন ধরে গৌতমবাবু ‘তালিপাম’-এর সন্ধানে ঘুরছেন। সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশেও তাঁর আসা যাওয়া রয়েছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে গিয়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কোয়ার্টার সামনে দেখতে পান গাছটিকে। গাছটিতে ফুল ও ফল এসেছে কি না জেনে, অপেক্ষা করতে থাকেন। স্থানীয়দের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগও রাখেন। বাংলাদেশের উদীচি গোষ্ঠী, গণ জাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে নিত্য যোগাযোগ বাড়ে। ২০১০ সালে খবর পান ফুল ফল এসেছে, বহু প্রতীক্ষিত গাছটিতে।

তিনি বলেন, ‘‘কিছুদিন পরে খবর পেলাম গাছটি মারা গিয়েছে। এরপরেই জানতে পারি বীজ সংরক্ষণ করেছেন ওদেশে। তখনই প্রকৃতিপ্রেমী ঊর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায় এবং নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী মানেকা গাঁধীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। ২০১৬ সালে ১৬ মে চিঠি লিখে পাঠাই। উত্তর পেলাম ১৮ মে। ওই চিঠি নিয়ে, তালিপামের চারা আনতে ১ জুন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু হয়। ওদেশের স্পিকার শিরিনা শারমিন চৌধুরী, বন মন্ত্রী আনোওয়ার হোসেন মঞ্জু, মুখ্য বনপাল অসিতরঞ্জন পালের সঙ্গে যোগাযোগ করি।’’ সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার চেয়ারম্যান তথা অধ্যাপক আবুল বাসার ও উদ্ভিদ বিদ্যা অধ্যাপক জসিম সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। এবং মোট ন’টি চারা নিয়ে ১৩ জুন দেশে ফিরে আসেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জন্মানো তিনশো চারার মধ্যে ২০১০ সালে বিতরণ করা হয় ১২০টি চারা। এর মধ্যে ১০০ চারা দেওয়া হয় বন বিভাগকে। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে সাতটি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’টি, বেইলি রোডের সামাজিক বন বিভাগকে দু’টি করে চারা দেওয়া হয়েছে। যে ন’টি চারা এসেছে এ দেশে, হাসিনা সরকারের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মেনকা গাঁধীকেও তার থেকে একটি করে গাছ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গৌতমবাবু।

গৌতমবাবু এ দিন তাঁর তালিপাম ফেরানোর কাহিনি বলেন। বিলুপ্ত প্রায় গাছ-গাছালি সংরক্ষণের জন্য নতুন প্রজন্মকে পাশে থাকার আহ্বান জানান। এ দিন সায়রবীথি ও লাইফ নামে একটি সংস্থার উদ্যোগে ওই ইকোপার্ক-এর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল বোলপুর ব্লকের বহু পড়ুয়া।

আয়োজকদের পক্ষে সম্পাদক দীপঙ্কর ঘোষ ও কালচারাল এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর অরূপ কুমার থান্দার জানান, স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে প্রকৃতি বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তুলতে এমন উদ্যোগ। বৃক্ষরোপণ, চিত্রকলা, গাছগাছালি, সাপ নিয়ে প্রদর্শনীর পরে পড়ুয়ারা কি শিখল তা নিয়েও হয় একটি প্রতিযোগিতা।

বিশ্বভারতীর উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান সুধেন্দু মণ্ডল বলেন, ‘‘বিরল এই গাছ দেশে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য গৌতমবাবুকে সাধুবাদ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tali palm tree corypha taliera
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE